'আনকণ্ডিশনাল লাভ' বলে কিছু হয় না
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ২০:০৫
কতগুলো কথা খুব পরিষ্কার করে মাথায় ঢুকিয়ে নেওয়া যাক। জগতে 'আনকণ্ডিশনাল লাভ' বলে কিছু হয় না। যতই আপনি মাদার্স ডে বা ফাদার্স ডে তে "মাই পেরেন্টস স্ট্রংগেস্ট" বলে পোস্ট দিন, বা ব্রেক আপের পর "শালা সব ছেলে/মেয়েই হারামি" বলে জেনারালাইজ করুন, বা পাবে/অফিসে/ হোয়াতে শ্বশুরবাড়ির লোককে/ পার্টনারকে খিস্তি করুন/ শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ঘোষণা করুন, আসলে সবার ভালোবাসাই কন্ডিশনাল। কিন্তু পার্টনার, প্রেমিক, বস, শ্বশুরবাড়ি খারাপ হবেই, এসব জেনারালাইজেশান ছোট থেকেই আমাদের মাথায় কোন না কোনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়, কাজেই তাদের কন্ডিশনাল ভালোবাসা লোকে সহজেই মেনে মানিয়ে নেয়।
- আমার শাশুড়ির সব ভালো, খালি জিনস পরতে দেয় না।
- আমার বর এমনিতে খুবই ভালো, দরকারের জিনিস কিনে দেয় সব, কিন্তু হাতখরচা দেয় না।
- ওদের বাড়িতে বউদের চাকরি করতে দেয় না। তা না দিক, আমার তো কোন অসুবিধা নেই ওখানে।
- প্রেমিককে খালি ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা দিয়ে রাখতে হয়েছে। তা দিলেই বা কী, ওর চেয়ে বেশি আমায় ভালো কে বাসে?
এগুলো সবই কন্ডিশন। এনারা আপনাকে ভালোবাসেন (বলে আপনি মনে করেন), কিন্তু আসলেই আপনি এনাদের নিজেদের পছন্দমত কাজ করেন, তাই এনারা ভালোবাসেন। একদিন নিয়ম ভেঙে দেখুন, ভালোবাসা রাত তিনটে অবধি জানলার ধারে বসে লুডো খেলবেন, হোয়াইল ইউ গাইজ ডু দ্য জিনা হারাম অফ নেইবারস। জানলা খুলে ফুরুৎ করে পারমানেন্টলি উড়েও যেতে পারেন ভালোবাসা ভদ্রলোক। কিন্তু এগুলোতে আমরা অভ্যস্ত। কারণ এগুলো হয়। এরকমই হয়, আমরা ছোট থেকে দেখে শুনে এসেছি। কিন্তু বাবা মায়ের ভালোবাসা! আহা সেসব স্বর্গীয় জিনিস! বাবা মা, তা সে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ঘুষ খাওয়া কেরানী হোন, বা বউ ঠ্যাঙানো মাতাল, বা শাশুড়িকে খেতে না দেওয়া খাণ্ডারনী বউমা, কিন্তু বাচ্চা পয়দা করে ফেললেই হয়ে যান স্বর্গচ্যুত অ্যাঞ্জেল! "পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা"! মানে আপনার বাবা আপনার ভরণপোষণের দায়িত্ব না নিলেও তাঁকে খুশি রাখলে সব দেবতা খুশি হন। "জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী"! কিস খুশি মে ভাই?
বাবা মায়ের ভালোবাসা আপনার প্রেমিক, পার্টনার, বস এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের মতই কন্ডিশনাল, এইটে ছেলেপিলেদের আগে বাপমায়েদের খানিক বুঝে নেওয়া ভালো। আপনি চান আপনার সন্তান হবে বিল গেটস, সে যদি দিয়েগো মারাদোনা হতে চায় তো আপনার ভালোবাসা ওই জানলার ধারে বসে থাকে, চাই কী ফুরুৎ অবধি হয়ে যায়। আপনি চান মেয়ে হবে মেরি কম, মেয়ে যদি হতে চায় সিন্ধুতাই সকপাল, আপনার হাতে এবং মুখে একে ফরটি সেভেন উঠে আসে। সতেরো বছরের বাচ্চা প্রেমে পড়বে খুব স্বাভাবিক, বা স্কুলে ভালো পারফর্ম না করতে পারলে পিয়ার প্রেসার থেকে তার ডিপ্রেশন হতেও পারে। আপনি মেয়ে/ছেলে প্রেমে পড়েছে শুনলে তিনদিন অন্নজল ত্যাগ দেন। সতেরো বছরের বাচ্চার ওপর এই ইমোশানাল ব্ল্যাকমেইল করতে আপনার বাধে না। ডিপ্রেশন শুনলে "হাতের কাছে সব পাচ্ছো তো, তাই এসব কায়দা করছো" বলে তাকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেন। পাশের বাড়ির মাসিমা ভাববেন "মেয়ে পাগল হয়ে গেছে" ভেবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান না। আর ইয়ে, মার খেয়ে বিবাহিতা মেয়ে ফেরত এলে কী করেন, সেটা আর নাই বা বললাম। সে তো সব্বারই জানা।
এই লেভেলের 'আনকন্ডিশনাল লাভ' ছেলেপুলেকে দিয়ে আপনারা ঈশ্বর সেজে ঘুরে বেড়ান। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ছেলেপিলে যারা জগতের এত মহানতা সারভাইভ করে বেঁচে গেল, তারা যখন বাবা-মা হবে, তারাও এই প্যাটার্ন কপি পেস্ট করে। এই কন্ডিশনাল ভালোবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে থাকে। ভালোবাসা কন্ডিশনালই হয়, আমি নিশ্চয়ই খামোখা কিছু একজন খুনীর প্রেমে পড়ে যাবো না দুম করে। যার প্রেমে পড়বো, তার কিছু গুণ (মানে যা আমার চোখে অন্তত গুণ) দেখেই পড়বো। বাপমায়ের ভালোবাসাও তাই। সেটা মেনে নিয়েও বলি, বাপমায়ের কিছু এক্সট্রা দায়িত্ব থাকে। ছেলেপুলেকে তার মত বড় হতে দেওয়া তার মধ্যে পড়ে। পাথ ব্রেকিং হলেও দয়া করে মেয়েকে ফুটবলার বানাবো, বা ছেলেকে গ্লোব ট্রটার ছোট থেকে মাথায় ঢুকিয়ে রাখবেন না। ওরা তাই হোক যা হতে চায়, যতক্ষণ না খুনী তোলাবাজ রেপিস্ট হতে চাইছে, তাতে কোন সমস্যা নেই। যদি কিছু শেখাতেই হয়, লাইফ স্কিল শেখান। পাঁচ সাত বছরের বাচ্চাকে শেখান কারোর অনিচ্ছায় তার গায়ে হাত দেওয়া অন্যায়। তা সে খেলার ছলে চুল টানলেও শেখান। দশ বছরের বাচ্চাকে শেখান তুমি যাকে বন্ধু করতে চাও, সে তোমায় নাও ভালোবাসতে পারে৷ তার চয়েস। বারবার তাকে বিরক্ত না করে অন্য বন্ধু খোঁজো। বারোতে শেখান স্কুলের কাজ এবং এক্সট্রা কারিকুলার কিভাবে প্রায়োরিটাইজ করে ম্যানেজ করতে হয়। শেখান, ইটস ওকে টু নট ফেয়ার ওয়েল ইন ওয়ান অর টু টেস্টস। ইটস ওকে টু লুজ। শেখান, বাট ইটস নট ওকে টু নট বি আপ এগেইন৷ ভাষা, বিজ্ঞান, অংক বা কম্পিউটার, এসব মোটামুটি কমবেশি সব বাচ্চাই শিখে যায়। লাইফ স্কিল শেখে না। সেইটুকু শেখানোই আপনার দায়িত্ব।
বাবা মায়ের নির্বুদ্ধিতায় আর অত্যাচারে যত ছেলেমেয়ে কষ্ট পেয়েছে, মরে গেছে, সারাজীবন যন্ত্রনা বয়েছে, তা বোধহয় আর কিছুতে নয়। প্রেমিক বা বর, বন্ধু বা বস খারাপ হলে বদলানো যায়। বাপ মা বদলানো যায় না। আর তাদের আপাত ভালোত্বের দায়ও ঝেড়ে ফেলা যায় না। আজকের বাচ্চাদের এমনিতেই কমপ্লেক্স জীবন। জগত সীমিত, মানুষের জায়গায়, সবুজের জায়গায়, সবটুকুই ভার্চুয়াল তাদের কাছে। দয়া করে এইটুকু মাথায় রেখে বাচ্চাদের আর বেশি যন্ত্রণা দেবেন না। ওদের একটু ওদের মত বাঁচতে দিলে বড্ড উপকার হয়। ধন্যবাদ।
লেখক: প্রকৌশলী