মধ্যরাতের গনগনে সূর্য
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৪২
আমাদের সকলের কাছে-স্বঘোষিত নারীবাদী, 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল নারীবাদী', ফেইমসিকার নারীবাদী, সেলার নারীবাদী- সকলের কাছে 'চরিত্র' অতি পবিত্র এক জিনিস। আমরা কিছুতেই চরিত্রহীন হতে রাজি নই। পুরুষ আমাদের ভালো চরিত্রের যে মসৃন চটকদার শাড়ি পরিয়ে দেয় সেই শাড়ি আমরা গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলতে রাজি না। তো আমাদের তাবৎ নারীবাদীদের মুখে সপাটে চড় মেরে সিএনজি অটোরিকশার মেয়েটি জানিয়ে দিল পুলিশ তার সাথে যা করছে তাতে তার বাল ছেঁড়া যায় না। আমার খুব নত হয়ে এই অপরিচিত মেয়েটির পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করে।
চরিত্র কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ তা আমি কোনওদিনই বুঝতে পারিনি। আমার ব্যর্থতা। কালকেই এক বন্ধুর পোস্টে কমেন্ট লিখেছিলাম। লিখেছিলাম যে, ছোটবেলা থেকেই, না স্যরি ঠিক ছোটবেলা নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমি একসময় লোকমুখে শুনতে পাই আমি খুবই খারাপ মেয়ে। আমার বয়ফ্রেন্ড গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতো আর আরেক বন্ধু মোটরবাইক নিয়ে। আমি দুজনের বাহনেই উঠতাম। আমি সবার সাথে হেসে কথা বলতাম, সহজভাবে মিশতাম। একটা পুরুষ এভাবে হেসে কথা বললে বা সহজভাবে সবার সাথে মিশলে তার 'নাম' হতো। সে মিশুক আর বন্ধুবৎসল হিসেবে খ্যাতি পেতো। আমি কি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলাম বুঝে নিন, লিখতে পারছি না। (সাংবাদিকতা করি সব কথা বলা যায় না, আমাদের 'চরিত্র' রক্ষা করতে হয়।)
তো আমি যে হিসেবে আখ্যায়িত হতাম সেই কাজ আমি করিনি। করলে বলতাম। তবে তখন থেকেই কেউ কাউকে চরিত্রহীন বলে আমার কাছে ফিসফিস করলে আমি তারে বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। আমার মনে হতো এই চরিত্রহীন নিশ্চয়ই এমনকিছু করার সাহস রাখে যা এই ফিসফিসকারী করার সাহস রাখে না। চরিত্রহীনদের আমি বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম তখন থেকেই।
সিএনজির এই মেয়েটিকে দেখি। আগুনের মতো মেয়ে। এই মেয়েকে কেন আমাদের সবার কাছে এতো ভালো লাগছে জানেন? তার দিকে ছুটে আসা খঞ্জরের আঘাতের প্রতিটা সে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভিকটিমহুড কার্ড খেলে নাই। তাকে বলা হয়েছে,
আপনি কি বিশ্বসুন্দরী নাকি যে আপনারে দেখবো? সে বলেছে, বিশ্বসুন্দরী আপনাদের চান্স দিবে?
তাকে বলা হয়েছে, বেয়াদব। বাসা থেকে কিছু শেখায় নাই? সে বলছে, না শেখায় নাই, আপনার কোন অসুবিধা?
তাকে বলা হয়েছে, হোটেল থেকে আসছে, সে বলছে, হ্যাঁ আসছি তাতে আপনার সমস্যা কি? আমি বেআইনী কি করছি বলেন।
তাকে বলা হয়েছে, ল্যাং মেরে থানায় নিয়ে যাবো, সে বলেছে, চলেন আমি যাবো। আমার অপরাধ কোথায় আমি জানতে চাই।
তারে বলা হয়েছে, ব্যাগ খোলেন সে বলছে, আমার ঠ্যাকা পড়ে নাই। আপনি খুলে দেখেন। আমার অনেক সময় এমনিতেই নষ্ট করছেন আপনারা।
তখন বলা হলো, কেন কেউ কি অপেক্ষা করে আছে? সে বলেছে, হ্যাঁ তোর বাপ অপেক্ষা করে আছে...
পুরো কথোপকথনটা আমাদের মতো এজেন্ডাবাজ নারীবাদীদের একাডেমিক থিওরির মতো মুখস্থ করা উচিত। কিভাবে চরিত্র এবং পুরুষতন্ত্রের সেট করা ইজ্জতের মালা টেনে খুলে ছিঁড়ে তাদেরই মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে হয় তা এই মধ্যরাতের গনগনে সূর্য আমাদের শেখালো। আপনি যখন নিজেই বলবেন, হ্যাঁ আমি চরিত্রহীন, তো? তখন পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র নার্ভাস হয়ে যাবে। চরিত্রের দাগরেও যারা দাগ হিসেবে মানতে রাজী না তখন তার মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতারে পুরুষতন্ত্রের বাধ্য হয়েই গুনতে হবে।
এরপর দেখেন, এই মেয়েটার ভিডিও কেন শেয়ার দিয়ে তার মানের আরও হানি ঘটাচ্ছি এমন বক্তব্যের বক্তারাও হাজির হচ্ছে। যে মেয়ে নিজেই মনে করছে না তার কোন মানহানি ঘটেছে তার মান নিয়ে আমাদের সমাজ চিন্তিত। সে কি করেছে যে তার মানের হানি ঘটবে? কি অন্যায় করেছে? এই সমাজে কেন এখনও ধর্ষণের শিকার নারীকে মুখে ওড়না পেঁচিয়ে আদালতে আসতে হয় জানেন? এই মানরক্ষাকারীদের জন্য। এখনও ধর্ষনের শিকার মেয়েটা চিৎকার করে বলতে পারে না, ইয়েস আই গট রেপড, যারা এটা করেছে তাদের শাস্তি দেন, তাদের সম্ভ্রম গেছে, আমার না। আমার সম্ভ্রম আমার গায়ে লেখা নাই।" বলতে পারে না, আমাদের মতো প্যানপ্যানানি মানরক্ষাকারীদের জন্য।
পুলিশ যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো পুরুষের কথা, আমাদের সমাজের কথা। পুলিশের যে আচরণ তা আমাদের সামগ্রিক সমাজের পুরুষের চরিত্রের একটা প্রতিচ্ছবি মাত্র। ফলে ইউনিফর্ম এর সম্মান টম্মান বলে যারা আফসোস করছেন- করে লাভ বিশেষ নেই। অন্যপক্ষতে একটা শো করেছিলাম, কোনও একটা সংস্থার জরিপ ছিল খোদ বাহিনীর ভেতরেই নারী পুলিশরা ৭০ শতাংশের বেশি নিগ্রহের শিকার হয়। জেন্ডার সংবেদনশীলতা কোনও প্রশিক্ষনে শেখানো যায় কি না সেইটাও প্রশ্ন।
যাই হোক, এই অসহ্য দমবন্ধ করা, নিজেকে অসম্মান করা সময়ে এই নাম না জানা মেয়েটি- যার গায়ে নারীবাদী ট্যাগ নাই- তারে আমার স্যালুট। সেই আমার কাছে সবচেয়ে বড় নারীবাদী।
লেখক: সাংবাদিক