আমাদের শিশু যাদুকরেরা
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০১৮, ১৫:৩৬
স্বার্থ ছাড়া, উচ্চ পদের লোভ ছাড়া এখনো এদেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব একটা কম নয়, যারা অন্ধভাবে কোন সিস্টেম, প্রথা, জাতিগত নিপীড়ন বা চলমান প্রক্রিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করে যায়। এমন মানুষের সংখ্যা কমে গেলে সে দেশের পরিবর্তনও থেমে যায়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংগ্রামের ইতিহাসে সামনে এগোনোর পথ শুধুমাত্র যে উচ্চবিত্ত, উচ্চপদস্থ নীতিনির্ধারণী এলিট শ্রেণীর মাধ্যমেই সুগম হয়েছে তা কিন্তু নয়। নেতৃত্বের জায়গায় সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং তরুণ ছাত্র ছাত্রীদেরকেই কণ্টকাকীর্ণ পথে হেঁটে রক্তাক্ত হতে হয়েছে অনেক বেশি। বাঙলায় আগ্রাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এই সাধারণ মানুষগুলোর অসাধারণ চেতনা থেকেই যে স্ফুরণ ঘটেছিলো তা এদেশের ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে লেখা রয়েছে।
ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ বাঙলায় নতুন কিছু নয়। বাহান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর এবং নব্বই এ আমরা আমাদেরই উত্তরসূরীদের জীবন তুচ্ছ করে ফেটে পড়া দেখেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও বাঙালি এক হয়েছিলো। এরপর নতুন করে আঠারোতে এসে জনমানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে যুক্ত হয়ে গেলো অবিস্মরণীয় অদ্ভুত এক শিশু বিদ্রোহ। এরা আমাদেরই অকুতোভয় সন্তান। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের দাবানলের মতো বিক্ষুদ্ধ হয়ে জ্বলে উঠেছে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সহপাঠির মৃতদেহ দেখে। কস্মিনকালে আশাও করিনি যে আমরা যা করতে পারিনি তা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে করে দেখাতে পারবে আমাদেরই মুখে ভাত তুলে খাওয়ানো আদরের সন্তানেরা। কিন্তু আমরা তো আমাদের সন্তানদের এভাবে কেউ দেখতে চাইনি। এটি তো তাদের কাজ নয়, এটিতো আমাদের বড়দের কাজ। শুধু আমরা কেনো, সারা বিশ্ব দেখছে শিশুরা বড়দের কাজ করছে।
গত ছ'দিন ধরে আমরা প্রাণ ভরে দু'চোখ মেলে দেখছি ক্ষুদে বিদ্রোহীদের উল্টো পথের গাড়ি রুখে দেয়া, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি আটকে দেয়া। বাস ট্রাক এক সারিতে, প্রাইভেট কার অন্য সারিতে, এবং রিক্সা এক লাইনে। মনেই হচ্ছে না এটি বাংলাদেশ, এটি ঢাকা শহর। শিশুরা দেখিয়েছে কিভাবে শিষ্টাচারের সাথে বড়দের গাড়ির লাইসেন্স এর বৈধতা যাচাই করা যায়। কীভাবে ক্ষুধার্ত থেকে বৃষ্টিতে ভিজে দাবী আদায় করে নিতে হয়। সর্বোপরি, কীভাবে নতুন করে মানুষের মনে আশা জাগানো যায়। তারা পথে নেমে প্রতিবাদ করছে অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে, কাজ করছে অনিয়মের বিরুদ্ধে। সারাদেশের মানুষের সাময়িক ভোগান্তি হলেও অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে এই যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতি।
কি সুন্দর করে ছোটরা আমাদের বড়দের জানিয়ে বুঝিয়ে দিলো উল্টো পথে গাড়ি চালানো অন্যায়। কি সুশৃঙ্খলভাবে অসুস্থ মানুষদের তারা এগিয়ে দিচ্ছে গন্তব্যে। দেখলে মনে হয় বহুদিনের পরিকল্পনায় এটি একটি বিশাল প্রোজেক্ট। অথচ এর কোন পূর্ব পরিকল্পনাও নেই, নেই কোন বিশেষ ব্যক্তির নেতৃত্ব। কর্মস্থলে যাবার পথে পাঁচ ঘন্টা আটকে থেকেও চোখের পলকে সড়ক পথের এই সংস্কারে ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীষণ উদ্বেলিত, উত্তেজিত এবং আন্দোলিত। আমাদের শিশু যাদুকরেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দেশকে নতুন করে গড়তে চেষ্টা করছে, এ অভূতপূর্ব দৃশ্য সত্যিই আমাদের বড়দের জন্য আশাজাগানিয়া এবং অহংকারের। কোন মা সম্ভবত এ দ্রোহে সন্তানদের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। কারণ আমরা জানি যে এরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরই নতুন প্রজন্ম, নতুন সংস্করণ। তাই এদের গায়ে হাত তোলার আগে একবার হলেও স্মরণ করুণ জীবনের নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদার অধিকার এদেশের সকল নাগরিকের রয়েছে কিনা।
এ মুহূর্তে মনে পড়ে বিদ্রোহী কবি তারুণ্যকে বলেছিলেন 'আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।' কবি গুরু বলেছিলেন 'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।' ইতিহাসে লেখা রয়েছে যে কোন জাতির বিদ্রোহীদের আমরণ সংগ্রামে প্রেরণা যোগানোর জন্য একজন ম্যান্ডেলা, একজন বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন। তাই যখনি প্রচণ্ড উত্তাপে মাথার উপরে বট বৃক্ষের ছায়া হাতড়ে বেড়াই তখনি মনে পড়ে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক বাণী 'আর দাবায়ে রাখা যাবে না।' প্রিয় সন্তানেরা, সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই তোমরা অত্যন্ত মহৎ একটি লক্ষ্য অর্জন করেছো। এবার মনে হয় তোমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।
লেখক: কলামিস্ট