ধর্ষক কীভাবে তৈরি হয়?
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০১৮, ১২:২৭
“ধর্ষকের ধর্ম নেই।”
“ধর্ষণের সাথে ধর্মের রাজনীতি মেশাবেন না।”
“ধর্ষণের মত অপরাধকেও ধর্মের সাথে মেলাচ্ছি আমরা!”
এসব যারা বলে বেড়ান, তাদের দু’চারটে কথা জিজ্ঞেস করি। খুবই বেসিক কথা। ভেবেচিন্তে উত্তর দেবেন। ধর্ষণ আসলে কী? ক্রিমিনোলজি বলে ধর্ষণ একটি পাওয়ার ক্রাইম। যাকে আমি নিজের চেয়ে কম, ছোট, নিচের মানুষ মনে করি, যার সম্পর্কে আমার ধারণা যে সে ক্ষমতার স্কেলে আমার নিচে, মানুষ তাকেই ধর্ষণ করে। যৌনখিদে মেটাতে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণে ধর্ষক স্বাভাবিক যৌনসুখ অনুভব করে না। যৌনাঙ্গে রড ঢোকানো বা যোনি চিরে দেওয়া এর বড় প্রমাণ। ধর্ষণে অত্যাচার করাই লক্ষ্য। ভিক্টিমকে দাবানো, তাকে শারীরিকভাবে কমজোর প্রমাণ করাই ধর্ষণের প্রধান লক্ষ্য।
এবার আসি পরের কথায়। পৃথিবীতে কোনো শিশুই ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। ধর্ষক তৈরি হয়। কেন? কীভাবে? বিভিন্ন ইনপুটের মাধ্যমে যখন তার মাথায় স্থির ধারণা হয় যে, বিশেষ কেউ তার চেয়ে ক্ষমতায়, মানে, সামাজিক অবস্থানে ছোট, তাকেই টার্গেট করে সে। নির্ভয়ার রেপিস্টরা, মানে তাদের উকিল অবধি পরিষ্কার বলেছিল, যে মেয়ে রাতদুপুরে একা বা ছেলে বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় বেরোয়, তার ধর্ষণ হওয়া জায়েজ। মেয়েমানুষের এত সাহস হবে কেন? এইটে হচ্ছে আসল কথা। মেয়েমানুষ ঊনমানুষ, তার বাইরে বেরোনোর সাহস হলে তাকে ধর্ষণ করা জায়েজ।
এই যে ইনপুট, এই ইনপুট কোথা থেকে আসে? আপনি বলবেন সমাজ থেকে। আমি বলবো ধর্ম থেকে। আমাদের সমাজে, আজ অবধি, সবচেয়ে বড় রুলবুক হল ধর্ম, আমাদের কোড অফ কনডাক্ট নিয়ন্ত্রিত এবং নির্ধারিত হয় ধর্ম দিয়ে। হিন্দুধর্মে গৌরীদান জায়েজ, ইসলামে তো নবীজী স্বয়ং রাস্তা দেখিয়েছেন। রাজস্থানে আজও শিশুবিবাহ রোজকার ঘটনা। মুসলিমদের ক্ষেত্রে তো দেশের আইনই ছাড় দিয়ে রেখেছে শিশু এবং বহুবিবাহের জন্য। ধর্ম কী শেখাচ্ছে? যৌনসম্পর্কের জন্য মেয়ের সাবালিকা হওয়ার প্রয়োজন নেই। যৌনসম্পর্কের জন্য নবছরের বাচ্চার ‘সম্মতি’ যথেষ্ট। ধর্ম কী শেখাচ্ছে? “ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি”। “বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে, তা সে ধর্ষণ হলেও, মেয়েকে শাস্তিদান করার বিধান।” ধর্ম শেখাচ্ছে মেয়ে যেহেতু কোনো পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাই তাকে বস্তা মুড়ে চলাফেরা করতে হবে, চিহ্ন ধারণ করতে হবে যাতে অন্য পুরুষের নজর না পড়ে।
এইসব ইনপুট নিয়ে বড় হয়ে ওঠা পুরুষদের কাছে ধর্ষণ করাই তো স্বাভাবিক। ধর্ষণে ধর্ষকের ধর্ম বিবেচ্য নয় বললে আমার তাই কুলকুলিয়ে হাসি আসে। স্ত্রী পুরুষের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা, শিশুকাম জায়েজ করা ধর্মকে নির্দোষ বললে হাসি পায়। দুএকজন লিবারাল নিয়ে আমাদের দেশ না। আমাদের দেশে আজও সমাজের শিক্ষা মানে আসলে ধর্মেরই শিক্ষা। ধর্ষক তার “আমি পুরুষ, কাজেই আমি ক্ষমতার আস্ফালন করতে পারি” এই শিক্ষা আসলে ধর্মের থেকেই পায়। মূল ক্ষত লুকিয়ে রেখে ছোট চোট আঘাতের চিকিৎসা করলে কী আর রোগী বাঁচে?
রোগীকে বাঁচাতে চাইলে জোর গলায় বলুন, ধর্ষকের ধর্ম অবশ্যই বিবেচ্য। রাজনীতি করার জন্য না। কারণ অপরাধ কম করার জন্য তা আগে স্বীকার করা জরুরি। স্বীকার করা জরুরি যে ধর্মের মধ্যেই এই অপরাধের বীজ নিহিত। ধর্মের শিক্ষার মধ্যেই ধর্ষক বানানোর উপাদান মজুদ। বেআইনি খাপ তো ছিলই, এখন আইন করে শরিয়া কোর্ট বানানোর কথাও হচ্ছে। ধর্মকে যতই তোল্লাই দিচ্ছি আমরা, তত বেশি ধর্ষক তৈরির রাস্তা সুগম করছি। এদিক ওদিকে আর্টিকেল লিখে, আইন বানিয়ে, সাজা দিয়ে এর খানিক প্রতিকার করা হয়ত সম্ভব, কিন্তু সমূলে নির্মূল করা সম্ভব না।
যতদিন ধর্ম থাকবে, বাপেমায়ে ছেলেপুলেকে নিয়ম করে ধর্মশিক্ষা দেবেন, ততদিন ধর্ষণও থাকবে। নিশ্চিন্ত থাকুন।
লেখক: প্রকৌশলী