চুলের চুলচেরা বিশ্লেষণ

প্রকাশ : ০৭ মে ২০১৮, ২২:২৭

চুল বিষয়ক সকল কাহিনী, উপন্যাস, কবিতা, রূপকথা, বিচার বিশ্লেষণ সবকিছুই নারীর চুল ঘিরে। এই চুল নিয়ে যেন মানুষের গবেষণার অন্ত নেই। আমরা এতটাই প্রতিভাবান যে নারীর চুলের ধরণ দেখেই তাকে বিশ্লেষণ ও সংজ্ঞায়িত করে ফেলতে পারি। নারীর স্বভাব চরিত্র, পূর্ববর্তী পরবর্তী চারিত্রিক ইতিহাস, লাইফস্টাইল, পেশা সবকিছুই চুল দেখে আমরা ভবিষ্যতদ্রষ্টার মত বলে দিতে পারি। আহ! কি মহান জ্ঞানী আমরা!

চুল দেখে নারীকে বিচার করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে নতুন নয়। ভাল খারাপ মান বিচার করতে প্রথমেই দেখে নেই সে নারীর চুল কেমন। নিজের কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি । 

একদিন দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বলছেন, “ওমা ভাবী জানেন না তো, অমুকের বউ চুল টুল কেটে পার্লার থেকে পাম করে চুল ছেড়ে দিয়ে কই যেন বেড়াতে যাচ্ছে। মেয়ে যে ক্লাস নাইনে পড়ে উনার কোন বিকার নাই, বয়স যেন কমছে , কি মা রে বাবা”। তার মানে ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ের মা হলে সে চুল কাটতে পারবে না ছাড়তেও না। তারপর দিকেদিকে রটে গেল তমুকের বউকে দেখলেই বুঝা যায় সে সংসারে মনোযোগী না, বাচ্চাদের খেয়াল রাখে না, সেজেগুজে ঘুরতে বের হয়। তিনি চুল কেটে বাতাসে উড়িয়ে হেঁটেছেন অতএব তিনি ভালো নারী নন। 

আবার আমার মায়ের নিজস্ব একটি কথা হলো মেয়েরা সন্ধ্যার পর চুল আঁচড়াতে পারবে না। এতে নাকি খারাপ নজর লাগে। রাতের বেলা চুল ছেড়ে বাইরে বের হলে ভূতেও ধরে। তাও আবার সাদা রঙয়ের মেয়ে হলে তাকে দিনেদুপুরেও ধরে। ভূত যেমনই হোক, কালো মেয়েতে আবার ভূতের নাক সিঁটকানো আছে কিনা। পৃথিবীর সকল ভূত জ্বীন ও পেত্নিদের আবার মেয়েদের প্রতি বিশাল ক্রাশ। তারা কোন ছেলের উপর ভর করেন না। 

রত্না আপা (ছদ্মনাম) প্রতিদিন অফিস যাওয়া আসা করেন। কোমড় ছুঁইছুঁই চুল বেণী করে অফিসে যান। কোনদিন সকালে গোসল করলে ভেজা চুল শুকানোর উদ্দেশ্যে ছেড়ে বের হতে গেলেই পরিবার থেকে নানান বাধা। ‘ভালো মেয়েরা’ নাকি চুল ছেড়ে বের হয় না। অগত্যা ভেজা চুল বেঁধে বের হয়ে সারাদিন মাথাব্যাথাকে সঙ্গী করা।

আমার নিজের কিছু বন্ধু আছে যারা সারাদিন অফিস করে, বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করে। সারাদিনের ধকল শেষে ক্লান্ত সে নিজের যত্নের সময় পায় না। প্রায়ই শ্বাসকষ্ট সমস্যায় ভুগে রাতে গোসল করে চুল না শুকানোর ফলে। চুল কেটে ফেলার কথা বললে সে খুব অসহায় ভঙ্গিতে বলে “না রে, তোর ভাইয়ার লম্বা চুল পছন্দ”। শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডায় মাথাধরা কোন সমস্যাই সমস্যা না। আমাদের ‘পতিদেবদের’ কমন কথা “মেয়েদের লম্বা চুলেই ভাল লাগে”। ‘আমার বউয়ের চুল অনেক লম্বা’ এটাও আমদের দেশের ছেলেদের কাছে গর্বের বিষয়।

কিছুদিন আগে শুনেছিলাম এক মেয়ে বিয়ে ঠেকানোর জন্য তার লম্বা চুল কেটে একদম ছোট করে ফেলেছিল। এবং অতি আশ্চর্যজনকভাবে অতি উৎসাহী ছেলেপক্ষ আর এগুয়নি, বিয়েটা বাতিল হয়ে গিয়েছিল শুধু চুলের কারণে।

আদিকাল থেকে চলে আসা কিছু বদ্ধ সংস্কার, ধর্মীয় ট্যাবু নারীর চুলের ক্ষেত্রে দিয়েছে নানা বাধ্যবাধকতা। মেয়েকে মেয়ে মেয়ে ভাব নিতে হবে আর তার জন্য চুল বড় রাখা অবশ্যম্ভাবী। কাটা বা উঠে আসা চুল যেখানে সেখানে ফেলতে নেই। যদি বা ফেলতে হয়, তা হলে নির্জন জায়গায় ফেলতে হবে। মাটি খুঁড়ে পুতে ফেলতে হবে নয়তো ফেলার আগে থুতু দিয়ে নিতে হবে। পূর্ণিমার রাতে জানালা খুলে মেয়েদের চুল আঁচড়ানো নাকি খুব অলক্ষণ, তাতে নাকি ঘরে অলক্ষী প্রবেশ করে।

আবার চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনী হাত থেকে পড়ে গেলে সেটাও খারাপ। মুরুব্বিদের সামনে চুল বাঁধা থাকতে হবে। চুলে রং করা যাবে না, চুল কাটা যাবে না এভাবে বাঁধা যাবে না, ওইভাবে বাঁধা যাবে না নানা কেচ্ছা কাহিনী। 

তার মানে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান, আমাদের সমাজ শুধুমাত্র চুল দেখে একজন নারীকে ভালো, খারাপ ট্যাগ লাগিয়ে দিতে পারেন। আমরা এতটাই বিশেষজ্ঞ যে মেয়ের লম্বা, খাটো, কালারড, স্ট্রেইট, কার্লি, পনিটেইল, খোঁপা, খোলা চুল দেখেই বলে দিতে পারি মেয়েটা, নষ্ট, বেশ্যা, দেমাগী, ঢংগী, চরিত্রহীন, আকাইম্মা, ইত্যাদি। এইজন্য আমাদের নিউজ পোর্টালগুলো আর্টিকেল লিখে “চুল দেখে চিনে নিন নারী” “চুল দেখে বুঝে নিন নারীর পেশা” এরকম আরও হাজার কিছু।

একজন মেয়ের বড় হয়ে ওঠার যাত্রায় সর্বদা মাথার মধ্যে পুশ করে দেয়া হয়, মেয়ে মানেই তার একরাশ দীঘল কালো লম্বা চুল থাকবে। নারীর সৌন্দর্য তার চুলে। রূপকথার গল্পে শেখানো হয়, রূপাঞ্জেলের দীঘল চুলে বেয়ে চলে আসবে স্বপ্নের কুমার। আমাদের কবি সাহিত্যিকেরা গুজরান গেয়েছেন বালিকার দীঘল চুলের। আমাদের পুরুষেরা সেই কাব্যিক দীঘল কালো চুলের বর্ণনায় বুঁদ হয়ে নিজের সঙ্গিনীর মধ্যে সারাক্ষণ বনলতা সেনকে খুঁজে বেড়ান। আমার একান্ত বিশ্বাস আমাদের ছেলেরা কখনোই তার কল্পনার সঙ্গিনীকে ঘাড় সমান চুলে কল্পনা করেন না।

আমাদের আশেপাশে অনেক মেয়ে আছেন যাদের লম্বা চুল পছন্দ। তারা সেটা মেইনটেইন করতে পারেন। আর অনেকেই আছেন যারা সেটা করতে পারেন না। তাহলে এই লম্বাচুলের ফ্যাসিনেশন, লম্বা চুলেই সকল সৌন্দর্য, নারীর নারী হয়ে ওঠার সাথে লম্বা ও কালো চুলের সম্পৃক্ততার বদ্ধ ধারণা দিয়ে কেন একজনকে বিচার করবেন?

স্বাধীনতার মানে কি?- যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, তখন আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। বলতে পারি না। তবে কেন জানি মনে হয় আমার অবাধ উড়তে থাকা চুলগুলোই আমার স্বাধীনতা। অনেক দূরে ইচ্ছেমত ভয়হীন কোন পাহাড়ের চূড়ায় ক্লিপ ব্যান্ডের বাঁধনহীন আমার চুল যখন তখন পতাকার মত উড়বে সেটাও আমার স্বাধীনতা। আমার চুল আমি যখন খুশি বাঁধবো, কাটবো, ছেড়ে রাখবো, কালার করবো। আমার চুল, আমার ইচ্ছে, আমার স্বাধীনতা।

লেখক: কপিরাইটার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত