এইসব লেখার প্রয়োজন ফুরাক

প্রকাশ : ০১ মে ২০১৮, ২১:৪৮

টানা সাড়ে আট বছরের কর্মজীবনে গত তিন মাস আকাশ থেকে টুপ করে পড়া একটা বিরতি পেয়েছিলাম 'শাপে বর' মতোন। ঘুরাঘুরি, হাত-পা ছড়িয়ে নিজেকে সময় দেয়া, সংসারের জঞ্জাল সরাতে আলসেমি আর অনিহাতে কেটেছে তিনটা মাস। সাথে ছিলো ফ্রিল্যান্স কাজ। ঠিক তিনমাস পর নতুন করে ন'টা-পাঁচটা অফিস। সারাদিন মুখ গুঁজে পড়ালেখা করলাম অফিসে, খাওয়াটা মনমতো হয়নি বলে একটু ক্লান্ত লাগলেও খারাপ ছিলোনা। ক্লান্তিটা তিনগুণ হয়ে গেলো বেরোবার আগে আগামী দু'দিনের ছুটিতে পড়ার জন্য আরো এক গাদা ডকুমেন্ট হাতে আসার পর!

ফেরার পথে ভেঙে ভেঙে আসতে হয় রিক্সায়। প্রথম পথ ভাঙার পরের রিক্সাটায় ওঠার সময় দেখলাম দু'জন লোক এগিয়ে আসছে। আমি রিক্সায় উঠলাম, একজন একটু আগেই আমাকে ক্রস করলো, অন্যজন ঠিক আমি ওঠার সময় ক্রস করলো। কিছু কি বললো?? হ্যাঁ, বললো তো। কী বললো? থাক, ক্লান্ত লাগছে। জানতে চাই না কী বললো। আমার রিক্সা এগোতে শুরু করেছে। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম। বেশ কিছুদূর চলে গেছে ওরা। আমার কানে কেন যে কথাগুলো অর্থ দাঁড় করালো এতোক্ষণ পর! -"কী ছোটো ছোটো মাল রে!"

ঘাড়ে হালকা ব্যথা। একে শিক্ষা দিতে গিয়ে নষ্ট করার মতোন শক্তি নাই আজকে, চুলোয় যাক। বিছানার আরাম আর পেট ভরে কিছু খাওয়ার ভাবনা এর চেয়ে স্বস্তির আপাতত।

এইসব কথা কখন 'কানে তুলে' দুই পা সামনে আগায়ে কিংবা পিছনে ঘুরে ধরে কয়টা শব্দ খরচ করে কিংবা হাতের কাছে যা পাই তা দিয়ে পিটায়ে কিংবা থাপড়ায়ে সোজা করতে হবে, আর কখন 'কানে না তুলে' বড় দুইটা শ্বাস নিয়ে নিজের কাজে চলতে হবে আমি জানি। কম বেশি সব মেয়েরাই জানে এই শহরে। কিন্তু যে ছেলেগুলি 'আহা মেয়েরা কতো বেশি কষ্ট করে' বলে সংবেদনশীল কিংবা 'মেয়েরা কী ঘোড়ার ডিমটা করতে পারে' ভেবে বিদ্বেষপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন- তারা কি এই জায়গায় নিজেকে বসায় ভাবতে পারেন? 

ভাবতে পারেন, অফিস থেকে বের হয়ে কিংবা বাজার সদাই শেষে পথে কানে হালকার উপর ঝাপসা ভেসে উঠা কথাটা, যেইটা আপনি বুঝবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না- ধরেন বললো 'একদম মরিচের সাইজ'। কিংবা ধরেন বললো 'ও বাবা, দাঁড়ায়ে আছে নাকি?' আপনি যদি তেড়ে যান, ধরেন উত্তর পেলেন 'আমি বাজার নিয়া কথা বলতেসিলাম পাশের জনের সাথে, আপনাকে বলি নাই। কোন সাইজের মরিচ লাগবে সেইটা আলাপ করতেসিলাম।' অথবা ধরেন উলটা তেড়ে বললো, 'আপনার এতো লাগে ক্যান? আসলেই মরিচের সাইজ নাকি?'

এখন বলেন, খুব খারাপ শোনালো? ঠিক অতোটাই খারাপ লাগলো না, আমার যেমন লাগে? আমার কিংবা অন্য যেকোনো মেয়ের এই শহরে এইসব কথা শুনে যেমন লাগে? আমরা শুনি। কয়দিন পরপরই শুনি।

মেয়েরা কেন এতো রেগে থাকে, কোথা থেকে আসে এতো ঝাঁঝ? যা দেখে কখনো পুরুষ বিদ্বেষ, কখনো ঝগড়াটে, কখনো তেজ দেখানো মাইয়া মনে হয় লোকের! যারা বলেন এইরকম পুরুষের সংখ্যা কম তাদের সাথে আমি একশ ভাগ একমত। কিন্তু এইরকম পুরুষরা এতো বেশি সক্রিয় তাদের অকাজ কুকাজে, যে বাকিরা যতোই মিনমিন করেন যে 'বেশির ভাগ পুরুষ এমন না'- তাতে মেয়েদের মনে কোনো দয়া হবে না। কারণ বাকি পুরুষরা মেয়েদের রাগ ঠ্যাকাইতে যতো তৎপর, এইসব লোকরে ঠ্যাঙাইতে ততো তৎপর এখনো হয়ে উঠেন নাই (দুই একজন কে আজকাল দেখি। তাদের অভিনন্দন!)।

চিত্রটা হলো, প্রত্যেক মেয়ে আজীবন নিয়মিত বিরতিতে এইরকম 'গুটিকয়' পুরুষ/ছেলের দ্বারা পথে ঘাটে হয়রানির শিকার। ঘুরে দুইটা থাপ্পড় দিলেও শেষে মেয়েটার ভুগতে হয়, ক্ষোভ চেপে চলে আসলেও মেয়েটার ভুগতে হয়। কখন কোনটা করবে সেইটা শুধু তার সময়, শক্তি আর সুযোগের ব্যাপার। ফলাফল হয় কচুটা।

আমি কেন এইসব লিখি এই নিয়ে আমার বন্ধুরাও বিরক্ত। তারপরেও কয়দিন নিজের জন্য বিরতি নেই, আবার লিখি। কখনো ঠান্ডা মাথায় লিখি, কখনো ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে লিখি। আর এইসব লেখার প্রয়োজন ফুরাক এই আশা করতে থাকি।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত