নারী কোটা বনাম নারী আসন
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ০১:১২
বিসিএসে নারী কোটার দরকার নেই কিন্তু বাসে সংরক্ষিত আসন কেন দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আগে সেক্স ও জেন্ডার সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে।
সেক্স একেবারেই প্রাকৃতিক ও জৈবিক ঘটনা। এগুলোর উপর আমাদের হাত নেই। যেমন: পুরুষের গোঁফদাড়ি গজায়, নারীর মিন্সট্রুয়াল হয়, নারী গর্ভ ধারণ করতে পারে, পুরুষ পারে না ইত্যাদি। এগুলো সারা বিশ্বের নারী পুরুষের জন্যই সত্য।
কিন্তু জেন্ডার একেবারেই সামাজিক কারণে সৃষ্ট। এর পেছনে রাজনীতিও থাকে প্রায়। তবে প্রাকৃতিক নয় কখনই। জেন্ডার স্থান কাল ভেদে বদলে যেতে পারে। জেন্ডার সচেতন হলেই আপনি বুঝবেন, নারীরাও সাইকেল, গাড়ি, প্লেন চালাতে পারে, এভারেস্টে যেতে পারে, প্যারাট্রুপার হতে পারে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, গবেষক হতে পারে ইত্যাদি। তেমনি পুরুষেরাও পারে রান্না করতে, ঘর গুছিয়ে রাখতে, সন্তান লালন পালন করতে, কাপড় কাচতে, ঘর মুছতে... ইত্যাদি। এখানে নারীর কাজ, পুরুষের কাজ বলে কিছু নেই।
বিসিএসে যে মেয়েটি আবেদন করবে বা পরীক্ষা দেবে, তাকে একজন পুরুষের মতই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয়। অর্থাৎ এখানে সবাইকে একই রকম যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হয়। এটা কোন জৈবিক/প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এটি জেন্ডারের মধ্যে পড়ে। এজন্যই আমি মনে করি নারীদের এখানে কোটার সুবিধা নেবার কোন প্রয়োজন নেই।
কিন্তু বাসে তাহলে সংরক্ষিত আসন কেন দরকার? এবার সেক্সের দিকটা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। একজন নারীর মিন্সট্রুয়াল চলতে পারে, গর্ভবতী হতে পারেন, সাথে দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকতে পারে ইত্যাদি। ইভটিজিং এর প্রসঙ্গটা না হয় বাদই দিলাম। এখন আপনারাই ভেবে বলুন, বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসন দরকার আছে কি নেই।
সত্যি কথা বলতে কি জানেন, এই প্রশ্নের উত্তরও জেন্ডারের মধ্যেই পড়ে যায়। এটা যদি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, জাপানের মত কোন দেশ হতো, আমি বলতাম, বাসেও নারীদের সংরক্ষিত আসনের দরকার নেই। কারণ, সেখানে সবাই লাইন ধরে সুশৃঙ্খল ভাবে বাসে উঠে। কারো গায়ে স্পর্শ যেন না লাগে তাই সবাই সতর্ক থাকে, ধাক্কাধাক্কি করা তো দূরের কথা, ইভটিজিং কেউ করতে চাইলে তার কপালে দুঃখ আছে। সেখানে সুন্দর রাস্তায় যানবাহনও মসৃণ, আরামদায়ক ও নিরাপদভাবে চলে। সুতরাং ওসব দেশে বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়ে না।
আর পাশাপাশি বাংলাদেশের কথা ভেবে দেখেন। ধাক্কাধাক্কি করে, লড়াই করে বাসে উঠতে হয়। একজন নারী যার মিন্সট্রুয়াল চলছে, কিংবা যিনি সন্তান সম্ভবা কিংবা যার কোলে দুগ্ধপোষ্য তার পক্ষে কি এই পরিস্থিতিতে যাতায়াত করা সম্ভব? এর মধ্যে একজন নারীকে তার পোশাক ঠিকঠাক রাখতে সচেতন থাকতে হয়। নিজেকে ইভ টিজারের হাত থেকে রক্ষা করতে এক হাত ব্যস্ত। আরেক হাত হাতের ব্যাগ পকেটমারের হাত থেকে রক্ষা করায় ব্যস্ত রাখতে হয়। জৈবিক যে ব্যাপারগুলোর কথা বললাম সেগুলো তো আছেই। এতকিছুর মধ্যেও পুরুষদের ভিড়ের মধ্যে নারীদেরকে বাসে উঠতেও দেওয়া হয় না। বীর পুরুষেরা আগে বাসে উঠে সংরক্ষিত আসনে বসে বসে নারীদের উঠাতে নিষেধ করে। তারা সম অধিকারের দোহাই দিয়ে বলেন, নারীদের কেন আবার আলাদা আসন দরকার?
জগতে আর কোন ব্যাপারে নারীর অধিকার নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই, অথচ বাসে মাত্র ৯টা (ক্ষেত্রবিশেষে ৩টা সিট) সংরক্ষিত আসনের বেলায় তারা সম অধিকার শেখাতে আসে! এত সম অধিকারই যদি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তবে বাসের অর্ধেক আসনই নারীদের জন্য রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশই এখন নারী। আর নারীরা তাদের শিক্ষা ও কাজের প্রয়োজনে আগের তুলনায় বেশি বাইরে বের হচ্ছেন।
তাই বিসিএসে নারী কোটার চেয়ে গণপরিবহনে নারীদের সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন অনেক বেশি।
লেখক: শিক্ষক