এ শহরে জায়গা কোথায়?
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৬, ১৯:০৮
“আমার সন্ধ্যাগুলো তোমার কাছেই যেতে চায়। কিন্তু এই শহরে জায়গা কোথায়?
সোনা এই শহরে জায়গা কোথায়?”
বল্লরী আমাকে এসএমএসটা দ্যাখায়। আমি চোখ টিপি।
: কি “লিটনের ফ্ল্যাট” চাই বুঝি?
বল্লরী হাসে না বা ওকে লজ্জ্বাও পেতে দেখিনা। বরং একটু আনমনা। বল্লরী আমার জীবনে সবিশেষ। এই মেয়েটাকে আমি চোখের সামনে হয়ে উঠতে দেখেছি। আমি দেখেছি কি করে মথ থেকে যন্ত্রণার একটা কাল পেরিয়ে পাখা মেলছে বর্ণিল প্রজাপতি। তাই ওর এই হঠাৎ চুপ করে যাওয়া আমাকে থমকে দ্যায়। বলি,
: ডিড আই হার্ট ইউ? সোনা?
ও বলে
: না তা না। লিটনের ফ্ল্যাট না আপা। একটু একলা কোথাও ওকে জড়িয়ে ধরে বসতে চাই। একটু ঘন হয়ে বসে দেখতে চাই আকাশ। কিন্তু এই শহরে জায়গা কোথায়?
সেই বিখ্যাত প্রশ্ন। আমাদের আগুন সুন্দরী, একসন্তানের জননী বল্লরী প্রেমে পড়েছে। সমাজ এত কাইন্ড এনাফ না যে তাকে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে কোথাও খুব ঘন হয়ে বসতে দেবে।
বল্লরীর এই সমস্যা বাদই দিলাম। তার নাম দুদিন বাদেই “পরকীয়া করা বা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নারী”দের তালিকায় উঠে যাবে। ও ব্রাত্য হয়ে যাবে। ওকে ঘৃণার চোখে দেখা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। কিন্তু ঐ যে নহলী আর্ট শেখে যে স্কুলে, সে স্কুলের স্বত্ত্বাধিকারী-রুমা, হিজাব করে, গত শুক্রবার দেখি খুব সেজেছে। গাঢ় গোলাপী রঙের সিল্কের সালোয়ার কামিজ। নেভীব্লু রঙ সিল্কের ওড়না একপাশে দেওয়া। অসাধারণ রূপসী রুমাকে বলি,
: স্কুল শেষ করে কোথাও যাবে নাকি বেড়াতে? এতো সেজেছো?
ও কোন এক বাচ্চার আর্ট খাতায় ফিগার আঁকছিল, চোখ না তুলেই বলে,
: নাহ, কোথায় যাবো? কোথায় যাওয়ার জায়গা আছে বলো তো? বাচ্চাদের নিয়ে খেতে যাওয়া আর কেনাকাটা করতে যাওয়া ছাড়া এই শহরে কোথায় একটু শ্বাস নিতে পারি, তুমি আমাকে বলবা? শিশু পার্কের একটা রাইড এ ছুটির দিনে আধাঘন্টা লাইন দিতে হয়। কোন খোলা জায়গাতেই মানুষের ভিড়ে নি:শ্বাস নেয়া যায় না, কোথায় যাবো? এ শহরে জায়গা কই?
এ শহরে জায়গা কই? বিখ্যাত সে প্রশ্ন।
এই প্রশ্ন সেদিন তুতানের জন্মদিনেও। অফিস থেকে একটানে শাহবাগ এসে পাঁচমিনিটের পথ পার হতে বসে রইলাম গাড়িতে ঘড়ি ধরে পঞ্চাশ মিনিট। পরিচিত যারা এসেছেন সবাই একসময় "ছবির হাট"-এ আড্ডা দিতাম। হয়তো সপ্তাহে একদিনই যেতাম, কিন্তু খুব প্রাণবন্ত আড্ডা হতো। কিন্তু ছবির হাট বন্ধ অনেকদিন। ছবির হাটের তর্ক, ঝগড়া, হাসি-ইয়ার্কি, দরাজ গলার গান, ঘন্টায় ঘন্টায় চা-বিড়ি-তেলেভাজার স্বাদ সব বন্ধ।
জায়গা কোথায়? এ শহরে জায়গা কোথায়?
আচ্ছা এই যে একটা শহর দিনে দিনে তার নাগরিকদের অর্ধমানব বানিয়ে ফেলছে, বানিয়ে ফেলছে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত অদ্ভুত এক জম্বি, আমরা কেউই কি তার প্রতিবাদ করছি? পয়সা যাদের হয়েছে তারা রেস্টুরেন্টে সপ্তাহে সপ্তাহে খেতে গিয়ে চেকইন দ্যায় বা চলে যায় ব্যাংকক-মালেশিয়া অথবা নিদেন পক্ষে গাজীপুর-পুবাইলের রিসোর্টে।
কিন্তু এর বাইরে বিশাল অংশ? যারা সোসালাইজেশন চায়? কফিহাউজ চায়, একটু গান-নাটক শুনতে দেখতে চায়, তারা? উত্তরার একজন মানুষ ওয়ার্কিং ডে তে একটা আবৃত্তির শো দেখতে চাইলে কি করবে? অথবা যদি দেখেও, দেখে সে নিরাপদে ঠিক কটায় ফিরতে পারবে ঘরে? একা বা পরিজনসহ?
বা কোন তরুণ বা তরুণী যে থাকে কুড়িল বা বাড্ডায় সে যদি যুক্ত হতে চায় নাটকের কোন দলে, সে মহড়া করতে আসবে শিল্পকলায়? বাস্তব চিন্তা? আসতে পারবে? না অত ডেডিগেশনওয়ালা তরুণ-তরুণী নয়, তারা আসবে কৌতুহলবশেই। সম্ভব? এ শহর সেই পথটুকু কি রেখেছে?
লুই কান, আপনি এঁকেছিলেন নতুন ঢাকার নকশা। আঁকতে আঁকতে বলেছিলেন, “এমন একটা শহর বানাতে চাই, যে শহরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণেরা গুছিয়ে নিতে পারবে তাদের স্বপ্নগুলো।”
দু:খিত মিস্টার কান, আপনার সে নকশা তবে পৌঁছায়নি আমাদের নগরপিতাদের কাছে। এ শহরের কাঁচে ঢাকা এক অফিসরুমে বসে বল্লরী তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ শহরের তরুণদের স্বপ্ন এখন কেবলই খাবি খায়, এলোমেলো হয়ে যায়, এতো হাইরাইজ আর কোলাহলের শহরটা আদতে যে এক মৃতনগরী তা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, আমি আর বল্লরী টের পাই!
লেখক: সাংবাদিক