আমাদের ধর্ষকামী বিনোদন মাধ্যম
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:২৩
বাংলা সিনেমায় নায়ক নায়িকার চুমু খাওয়ার সময় এলেই বিটিভিতে দুইটা গোলাপ ফুলের ঠোকাঠুকি কেন দেখাতো তা ছোট বেলায় বিরাট এক জিজ্ঞাস্য ছিল আমার কাছে। এখন বুঝি। নারীপুরুষের স্বাভাবিক প্রেম এদেশের সিনেমায় বা বিনোদন মাধ্যমে চিরকালই পরিত্যাজ্য বা লজ্জ্বার বিষয়, কিন্তু ধর্ষণ ঠিক আছে। তাই ধর্ষণটা ঠিকঠাক দেখানো হয়। আমার মনে পড়ে না নার্গিস আক্তারের এইডস বিষয়ক একটা চলচ্চিত্র ছাড়া আর কোন সিনেমায় আমি স্বাভাবিক যৌন দৃশ্য দেখেছি কি না, তবে ধর্ষণ দেখেছি অজস্র। অজস্র ধরনের ধর্ষণ। এ বিষয়ে আমাদের পরিচালকরা অত্যন্ত ইনোভেটিভ।
আমাদের বিনোদন মাধ্যম স্পষ্টতঃই ধর্ষকামী। কয়েকটা কমন বিষয় লক্ষ্য করুন।
১। আমাদের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই নায়ক নায়িকার প্রেম হয় ঝগড়া থেকে। নায়ক অধিকাংশ সময়ে ভয়ংকর রকম উত্যক্ত করে নায়িকাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এইরকম উত্যক্তকারী নারীর জন্য বিভীষিকা হলেও সিনেমায় উত্যক্তকারীকে দেখানো হয় প্রেমিক হিসেবে। নায়িকা একটা সময় এই উত্যক্তকারীর প্রেমে পড়েই। নায়ক কি কি বিষয় নিয়ে উত্যক্ত করে? নারীর পোশাক নিয়ে, শ্রেনী নিয়ে এবং নারীর শরীর নিয়ে। টাইটফিট পোশাক অথবা টাইট প্যান্ট, ওড়না না পরা, হাইহিল পরা- এইগুলি টিজের মূল বিষয় থাকে। কখনও দেখানো হয় বদরাগী নায়িকাকে। নারী বদরাগী হতে পারবে না বা তার মেজাজ দেখানো চলবে না। রাগী নারীকে 'সাইজ' করার সকল পদ্ধতি নায়কের থাকে যেটা অত্যন্ত যত্নের সাথে পরিবেশন করা হয়।
২। নায়িকা ভিলেন দ্বারা আক্রান্ত হলে নায়ক এসে তাকে উদ্ধার করে। এবং আগে এই নায়ক মেয়েটিকে যতই উত্যক্ত করুক সম্ভাব্য ধর্ষণের হাত থেকে তাকে বাঁচানোয় এই নায়কের প্রতি তার প্রেম তৈরি হবেই। ধর্ষণ নারীর জন্য ইজ্জত যাওয়া ব্যাপার। তাই যে এই বিরাট ইজ্জতটা বাঁচালো তার প্রেমে না পড়ে পারা যায় না। সে ব্যক্তি যেই শ্রেনীর হোক, যে চরিত্রের হোক তার প্রেমে নায়িকাকে পড়তেই হবে। সম্ভাব্য ধর্ষণকে প্রেমে পড়ার উপাদান হিসেবে দেখানো হয়।
৩। "চুমকী চলেছে একা পথে" টাইপের হাজার হাজার যৌন নিপীড়নমূলক গান এবং সেইসব গানের দৃশ্যায়ন আমাদের সিনেমায় হয়েছে।
৪। ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেখানো হয়েছে এরকম সিনেমাও আছে বাংলাদেশে। অথবা ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে যাওয়ায় ধর্ষককে মেয়েটিকে বিয়ে করতে মেয়ের বাবা মা হাতে পায়ে ধরছে এই দৃশ্য বিরল নয়।
৫। ধর্ষণের শিকার কোন নারীকে সিনেমায় বাঁচিয়ে রাখার চল নেই। তাকে মরতেই হবে। ধর্ষণ নারীর 'সম্ভ্রম' নষ্ট করে, যে 'সম্ভ্রম' জীবনের চেয়েও বেশি গুরত্বপূর্ণ, তাই 'সম্ভ্রম' যাওয়া মানে জীবন চলে যাওয়া।
৬। ধর্ষণ পরবর্তী নারীকে দেখানো আরেক বিনোদন। ছেঁড়া জামা বা ব্লাউজ পরা নারী, এলোমেলো চুল, শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন- এইসব নতুন যৌনাকাঙ্খা জাগায় পুরুষের।
৭। আমাদের সিনেমায় দৃশ্যকাম সবসময় দারুণভাবে সমাদৃত। হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত 'লম্পট' সিনেমাটার কথা মনে করুন। সেখানে দেখানো হয়, গ্রামে নতুন বিবাহিত দম্পতির মিলনদৃশ্য গোপনে দেখে আনন্দ পান ফরীদি।
৮। শুধু যৌনতা নয়, নারীর শরীর প্রদর্শনের বিষয়টুকু ছাড়া নারী শরীরের কোনকিছুই স্বাভাবিক আলোচ্য নয়। এ যাবৎ কালে নায়িকা প্রেগনেন্ট হলে লুকিয়ে তেঁতুল খাওয়া অথবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরে ডাক্তার এসে প্র্রেশার চেক করে "আপনার স্ত্রী মা হতে চলেছেন" বলা হয়। কোন তথ্যের ভিত্তিতে ডাক্তার এই কথা বললো তা বলা হয় না। নায়িকার লাজুক হাসি জানিয়ে দেয় এটা খুব লজ্জার কাজ মানে প্রেগনেন্ট হওয়াটা।
এই সবকিছুর বিপরীতে সুস্থ যৌনদৃশ্য মনে করার চেষ্টা করুন তো বাংলা সিনেমায়। পেলে আমারে জানাবেন। 'টু উইম্যান' সিনেমায় সোফিয়া লরেন অভিনয় করেছিলেন যুদ্ধে যৌন সহিংসতার শিকার এক নারীর চরিত্রে। ঋতুপর্ণ ঘোষ 'দহন' সিনেমায় দেখিয়েছিলেন, ঋতুপর্ণা সেনকে তুলে নেয়ার চেষ্টা যা দেখে মূলত ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার রূপ কি তা বোঝা যায়। আমাদের মর্দামিপ্রিয় এবং ব্যাডাগিরিযুক্ত সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রিতে রিয়েল লাইফ এবং পর্দাতেও হিরো হলো ক্ষমতার চর্চা করা, নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখা শাকিব খানরা। বাংলা সিনেমায় অনেক উদ্ভট জিনিস দেখানো হলেও ধর্ষণ আক্রান্ত কোন নারী পুরুষের বলস বরাবর লাত্থি কষাচ্ছে এইরকম দৃশ্য দেখানো হয় না। দেখানো হয় না কারণ, ধর্ষন যতটা না পর্দার ভিলেন করে, পরিচালক এবং সিনেমার পুরুষ কলাকুশলীরা ততোধিক করে। মনে মনে। হয়তো বাস্তবেও। জানা যায় না আর কি।
লেখক: সাংবাদিক