পূর্নিমার জীবনে ধর্ষণের আনন্দ - আমাদের মুখে সশব্দ চড়!

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:১৫

আচ্ছা, আঁতকায়া যে উঠলাম, ক্যান উঠলাম? এইজন্যই কি যে পূর্ণিমা একজন চিত্রনায়িকা, একজন নারী? আমরা কি এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না? কিন্তু কেন প্রস্তুত ছিলাম না? এই যে পূর্ণিমারা যেসব সিনেমায় অভিনয় করে, এর ভাঁজে ভাঁজে দেদারসে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ধর্ষণ দৃশ্য- সে তো বিনোদন হিসেবেই। ধর্ষণ ছাড়া কোন বাংলা সিনেমা হয় ঢালিউডে? 

এই পূর্ণিমারাই তো ধর্ষণ দৃশ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। টিকিয়ে রেখেছে নারীর ওপর অনাচার, অত্যাচার, অপমান আর নোংরামি সিনেমার মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দেবার ধারাকে। তারা কি কোনদিন মানুষ হিসেবে মনে করেছে নিজেদেরই? তারা কি মনে করে একজন নারী শুধু নয়, একজন মানুষও শিল্পী হিসেবে এইসব নোংরামির বিরুদ্ধে অন্তত একবার মুখ খোলা উচিত?

না, মনে করে না। মনে করে না বলেই, প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বরং সিনেমা ও সিনেমা জগতে নারীর প্রতি নোংরামি আর অনাচারকে তারা সহাস্যে বরণ করে নেয় এবং স্থায়ীকরণে কাজ করে। কারণ, ধর্ষণ সত্য অর্থেই তাদের কাছে একটি নিত্য ঘটমান সাধারণ বিষয়। ধর্ষণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তারা।

কিন্তু ধর্ষণ তো এক বিভীষিকা। ধর্ষণ তো নারীর এক চরম অপমান। ধর্ষণ তো বিউটির রক্তলাল ছিন্ন জামা, ধর্ষণ তো ছোট্ট নুসরাতের গলিত বিকৃত শরীর- বেঁকে যাওয়া, বীভৎস। ধর্ষণ তো তনু, ধর্ষন তো পূজা- যোনী বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী সাইদুলের বিকৃতির পথ তৈরি করে বীভৎস উৎসব!

এই ধর্ষণও তবে কারো কারো জীবনে বিনোদন? বেঁচে থাকার রুজি-রোজগারের পথ? আমোদ আহ্লাদের উপায়? ধর্ষণ তবে হাহাহিহি হাসির খোরাক? ধর্ষণ তবে আনন্দের?

আমার নারী জীবনের মুখের ওপর যদি কোনদিন সশব্দে একটা চড় খেয়ে থাকি, তবে সেই চড়টা গতকাল চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা আর মিশা সওদাগরের টিভি অনুষ্ঠানের কথপোকথন শুনে খেয়েছি। লাস্যময়ী ভঙ্গমিায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে পূর্ণিমা!
 
- সিনেমায় কতবার ধর্ষণ করেছেন? কেমন লেগেছে ধর্ষণ করতে?
- মিশা সওদাগর: অনেকবার করেছি।
- পূর্ণিমা: কাকে কাকে ধর্ষণ করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
- মিশা- পূর্ণিমা আর মৌসুমীকে।

হে ঈশ্বর, এর আগে আমারে উঠায়া নিলেই পারতা। এই দেশ এই জাতি এদেশের মানুষ আমরা- নির্লজ্জ হতে হতে কতটা নিচে নামিয়ে নিয়েছি নিজেদের যে এই অশিক্ষিত, বর্বর, নোংরা, জঘন্য মানুষগুলোই আজ শিল্প সংস্কৃতির নামে করে খেয়ে যাচ্ছে। এরা ধর্ষণকে প্রতিষ্ঠিত করছে বিনোদন রূপে। ইভটিজিং, নারীকে উত্যক্ত করা, ধর্ষণ করা- সবই সিনেমার পর্দায় অত্যন্ত সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা এই ২০১৮ সালেও। এখনও নারীর সর্বস্ব ত্যাগই সিনেমার প্লট। আর নারীর ওপর ধর্ষণ দৃশ্য ছাড়া সিনেমাও জমে না। সেই সিনেমায় প্রযোজক পরিচালকের নির্দেশে নিজেকে বেচে, শরীর প্রদর্শন করে, পণ্য হয়ে একদিন কোটি টাকায় জমজমাট হয়ে ওঠে নায়ক নায়িকা। তারপর বুড়িয়ে গেলে মাথায় হিজাব উঁচিয়ে হজ ওমরা পালন করে ফেরেন। গ্রামে একটা এতিমখানা আর মাদ্রাসা বানিয়ে মুখে তেলতেলে হাসি ঝুলিয়ে হয়ে ওঠেন চিরকালীন ধার্মিক। এদেশে ধর্ম সবচেয়ে ভালদামে পাওয়া যায়। তাদের ধর্মচিন্তায় বিউটি নেই, তনু নেই, পূজা নেই, নুসরাত নেই। আছে ‘আহউহ’ অর্গাজমের শব্দে ধর্ষণকে উপভোগ্য করে তোলার চিত্র। কিন্তু তবু তারাই সম্মানিত চিত্রজগতের মহামান্য মহামান্যা।

অথচ মাত্র সপ্তাখানেক আগে অভিনেতা মোশাররফ করিমকে আপোষ করতে হল। ‘পোশাক কখনও ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়’- এই সত্য উচ্চারণের পর মৌলবাদীদের আক্রমনের মুখে পড়ে নিজের বক্তব্য তুলে নিতে বাধ্য হন মোশাররফ করিম।

এই আমার স্বদেশ! ধর্ষণের সামাজিক বৈধতা দেয় এই সমাজ। বিনোদন জগতে মেরুদন্ড উঁচু করে ধরে থাকা কেউ নেই। আছে ধর্ষণের পৃষ্ঠপোষক, ধর্ষণের উৎসাহদাতা, ধর্ষণকে রীতিমত শিল্পে পরিণত করা করিৎকর্মা অশিক্ষিত নায়ক নায়িকা।

তীব্র ঘেন্না প্রকাশ করছি। তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যতটা প্রতিবাদ জানালে পূর্ণিমা নতমস্তকে ক্ষমা চাইবে, ক্ষমা চাইবে মিশা, ক্ষমা চাইবে আরটিভি, ক্ষমা চাইবে ওই অনুষ্ঠানের প্রযোজক এবং সংশ্লিষ্ট সকলে।

মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি আহ্বান, ধর্ষণের মত সেনসিটিভ ইস্যুকে পুঁজি করে বিনোদন তৈরি এবং সমাজে ভুল বার্তা দেবার দায়ে এদের সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার পথ বের করুন। এদেরকে আমরা যেন উপযুক্ত শাস্তির মুখোমুখি করি। এরা যেন নিজেদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি ভোগ করে।

লেখক: লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত