খামোশ! চুপ রও!
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০১৮, ২২:৩৩
মোশাররফ করিম ক্ষমা চাইলেন! হায় কপাল! নিজের কপালে নিজের হাতের তালু দিয়া তিন থাপ্পড় দিয়া বললাম, হায় কপাল! হায় কপাল! হায় কপাল! তিনি যা বলেছেন, সেটা খুব সাধারণ যুক্তিনির্ভর কথা; এটা তো মেঘনার চরে মহিষ চড়ানো রাখাল বালকটিও বলবে, পাতাকুড়ানি কিশোরীটিও বলবে। বিশ্বাস না হয়, জিজ্ঞেস করে উত্তর শুনে নিন।
শুনলেন তো?
এইবার আমার কথা শুনুন....
আদিম কালের মানুষের জ্ঞানে যখন পোশাক পরার ধারণাটিও জন্মায়নি, তখন তারা ছিল গুহাবাসী, বিচরণ করতো বনে-জঙ্গলে। আধুনিক মানুষের মতো নিজ দেহ নিয়ে হীনমন্যতা তাদের ছিল না, দেহের লজ্জার স্থানগুলো তখনও তারা চিহ্নিত করতে পারেনি; সারা জীবনই তারা ছিলো উলঙ্গ। এই উলঙ্গতা তাদের নানাবিধ দৈহিক যন্ত্রণার কারণ হত। বিছানাহীন গুহায় ঘুমিয়ে থাকা বা বনে-জঙ্গলে বিচরণকারী উলঙ্গ মানুষগুলো পোকামাকড়ের বিরামহীন দংশনযন্ত্রণা সহ্য করেছে, মৌসুমী শৈত্য প্রবাহের শীতল কামড় সহ্য করেছে, গ্রীষ্মে সূর্যের তাপদাহ সহ্য করেছে। উলঙ্গতার লক্ষ লক্ষ বছর সেকালের মানুষ এসব সহ্য করেই টিকে থেকেছে। যারা সহ্য করতে পারেনি, তারা রোগযন্ত্রণায় অকালে প্রাণ হারিয়েছে। এ সবকিছুই আমরা জানি।
আমরা এও জানি, তখন ধর্মগ্রন্থ বলতে কিছু ছিল না। তখন অধুনা কথিত "সব জ্ঞানের আধার" কোন ধর্মগ্রন্থ আবির্ভূত হয়ে বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে এই হতভাগা, দুর্বল প্রাণীটির পাশে এসে দাঁড়ায়নি; বস্ত্র তৈরীর কৌশলটি শিখিয়ে দেয়নি বা অরক্ষিত উন্মুক্ত দেহটি বস্ত্র দ্বারা জড়িয়ে রক্ষা করার কৌশলটিও কানে কানে বলে দেয়নি। শৃঙ্গহীন, দাঁতহীন, নখহীন, শারীরিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল প্রাণীটিকেই এসব করতে হয়েছে মগজ খাটিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে। তারা তন্তু তৈরী করতে শিখেছে, বুনন শিখেছে, শিখেছে বস্ত্রের আবরণে নিজেকে আবৃত করে দেহরক্ষা করতে। আবরণে আবৃত করে দেহরক্ষা করার এই কৌশলটি জানতে মানুষ নামের প্রাণীটিকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছরের যন্ত্রণার পথ। এই দীর্ঘ সময়ে ঈশ্বর প্রেরিত কোন ধর্মশাস্ত্র আকাশপথে উড়ে এসে মানুষের দুর্দশাকে নিবারণ করেনি। এসেছে যজ্ঞশেষে, এসেই হাতে তুলে নিয়েছে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের নির্মম দণ্ড।
লক্ষ লক্ষ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমণ শেষে এখন পোশাক কেবলমাত্র দেহরক্ষাকারী আবরণ নয়, এটা সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন মানুষ পোশাক নির্বাচন করতে বিবেচনায় আনে ঋতু, আবহাওয়া, সাচ্ছন্দ্য, পরিবেশ, ব্যক্তিত্ব, স্টাইল, চলতি ফ্যাশন, জাতি বা গোষ্ঠীগত ঐতিহ্য ইত্যাদি। এজন্যই, পোশাক এখন আর শুধু একটি আবরণ নয়, একটি জাতির উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি এবং জাতীয় পরিচিতিও বটে। এসব ছাড়িয়েও পোশাক সংস্কৃতির এখনকার জৌলুস, কৌলীন্য ইত্যাদি এখন সভ্যজগতে রীতিমতো আর্টের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতি হিসাবে আমাদের পোশাক সংস্কৃতিও লক্ষ বছরের পরিক্রমায় দেহরক্ষাকারী আবরণ থেকে আর্ট-এ উন্নীত হয়েছে। বর্তমান পোশাক সংস্কৃতি শুধুমাত্রই আমাদের পরিশ্রম, সৌন্দর্যবোধ আর উদ্ভাবনীশক্তির ফল। এই ফলটি অর্জনের দীর্ঘ পরিক্রমার কর্মযজ্ঞে কোন ধর্মগ্রন্থের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই, ছিলও না। যেহেতু কোন ধর্মশাস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই আমরা আবরণ তৈরী করতে শিখেছি, আবার সেই আবরণকে জৌলুসপূর্ণ আর্টের পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি, তাই স্বাধীনভাবে পোশাক নির্বাচন করার পূর্ণ অধিকার একমাত্র আমাদেরই। কাজেই, কোন ধর্মগ্রন্থেরই অধিকার নেই আমাদের পোশাক নির্বাচনের, পরিধানের স্বাধীনতায় অযাচিত খবরদারি করার। যেসব ব্যক্তি ধর্মগ্রন্থের পাতা খুলে আমাদের স্বাধীনতায় খবরদারি করছেন, তারা সীমা অতিক্রম করছেন। সীমা অতিক্রম করা অন্যায়।
উপরোল্লিখিত অন্যায়কারীদের জন্য রইলো উপরের শিরোনামের বাক্যটি.....খামোশ! চুপ রও!
লেখক: চাকুরীজীবী