মুক্তিযুদ্ধে এক অদম্য নারী

প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০১৮, ২৩:২৭

সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রথম সন্তান, সামাজিক প্রথা ভেঙ্গে বাবা তাকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। দুরন্ত কৈশোর পেরোবার আগে পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। স্বামী অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের একমাত্র সন্তান, সুপুরুষ তরুণ তুর্কী তখন কলেজের ছাত্র। রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারো আগে থেকেই। সংসার বুঝতে হয়েছে তাকে প্রবল প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে।

১৯৭০ এর নির্বাচনী ডামাডোলে প্রথম সন্তানের আগমন, তার কোলে তুলে দেয়া হয়েছিল তখন একটি জীবন্ত পুতুল। জাতির পিতা হাওর অঞ্চলে তখন নির্বাচনের জন্য প্রচারণায় এলে স্বামী ছিলেন ছায়াসঙ্গী, সেই সাথে তরুণ নেতা মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সাহেবের নির্বাচনের একনিষ্ঠ কর্মী সংগঠক। গোটা হাওর চষে বেড়িয়েছেন স্বামী আর স্ত্রী হিসেবে, কর্মীদের খাবারের যোগান দিয়েছেন এই নারী সন্তান কোলে নিয়েই।

নির্বাচনে জয়ী হলেও আমাদের বঞ্চিত করে এবং শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে উত্তপ্ত এই মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু চুড়ান্ত সংগ্রামের ছক এঁকে রূপরেখা ঘোষণা করেন ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় তদানীন্তন নিকলী থানায়, বিপুল জনসমর্থনে সেক্রেটারী নির্বাচিত হলেন তার স্বামী। জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আহবান এবং নেতা আব্দুল হামিদ (বর্তমানে মাহামান্য রাষ্ট্রপতি) এর নির্দেশনায় মুক্তিসেনার খোঁজে নেমে গেলেন পুরোদমে।

পরিবার ও সন্তানের জন্য কি কোন দায়িত্ব নেই তোমার? স্বামীকে একদিন কাছে পেতেই তীব্র ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। গোটা দেশ আমার পরিবার, প্রতিটি মানুষ আমার সন্তান, এই পরিবারের তুমি ও আমার কন্যা একজন সদস্য মাত্র ... দেশ স্বাধীন না হলে তোমরা কেউ নিরাপদ নও, তোমাদের জন্য একটা দেশ জয় করে তবেই ঘরে আসবো। ফিরে না এলে ক্ষমা করে দিও আর এই গৌরব নিয়ে বেঁচো: তোমার স্বামী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, শহীদ ... প্রিয়তম কন্যাকে বলো: ভীষণ ভালোবাসি, মানচিত্র খচিত লাল সবুজের একটা পতাকা আনতে গিয়েছে তোমার বাবা।

সেদিন একরাতেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল সে, যুদ্ধ এবং স্বামীর আদেশ তার তারুণ্য কেড়ে নিয়েছিল, কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছিলেন দায়িত্বের পাহাড়। বয়োবৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়িকে বুঝতে দিতেন না। আত্মগোপনে থাকা স্বামী মাত্র ২৬ জন সহযোদ্ধা নিয়ে নৌকায় করে হাওর পাড়ি দিতে একদিন রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগ করেন।

চিরকুট পাঠিয়ে নির্দেশনা পাঠাতেন, সেই বার্তায় ভালোবাসা নয়, থাকতো কাজের ফিরিস্তি, কি করতে হবে তাকে। অর্ধশত যোদ্ধা এই মহিয়সী নারীর সহায়তায় যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছে একাত্তরে। চাপা থাকেনি এই যোগাযোগের বিষয়টি আর তখন বসে ছিল না এই দেশের কুলাঙ্গার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা। ঘরছাড়া হলেন, দুধের সন্তান কোলে ফেরারী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হলেন।

আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন আত্মীয় পরিজনের ঘরে। পালিয়ে বেরিয়েছেন, একদিন পুবের হাওড়ে ধোঁয়া উড়িয়ে টাগবোটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগমন তার স্বামীর ভিটায়। দ্বিতল ঘর, দুইটি দোচালা ঘর, বাংলা ঘর, ধান আর পাটে পরিপূর্ণ কাচারি গানপাওডারে জ্বালিয়ে দেয়ার আগে তার শ্বশুরকে স্টেনগান ঠেকিয়ে ছেলের সন্ধান দিতে বলেছিল সেনারা। স্পষ্ট স্বরে জবাব দিয়েছিল, জ্বালিয়ে দাও, আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আর কিছুই চাই না। পূর্ব পুরুষের স্মৃতি আর বউ শাশুড়ির স্বর্ণালংকার পুড়ে ছাই হয়েছিল সেদিন।

স্বামীর অনুপস্থিতিতে সহায় সম্বল গ্রাস করতেও দ্বিধা করেনি কিছু সুযোগ সন্ধানী, নূন্যতম সম্মান করেনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারকে। আজ অনেকেই বড় বড় কথা বলেন, সমান অংশগ্রহণ এবং সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে দাবী করেন, সেদিন কিন্তু এমনটা ছিলো না। হিংস্র শ্বাপদেরা আশেপাশেই ছিলো।

মৃত্যুকে সাথী করে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন সেই নারী যুদ্ধরত স্বামীর সাথে। ভারতের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এলেও স্বামীর দেখা তিনি পাননি। রনাঙ্গণের অনিশ্চয়তা ও ভয়াবহ সম্মুখ সমরে দেশ তখনো উত্তাল। এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সময় তাকে ঋদ্ধ করেছে, সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কোন রূপকতার গল্প ছিলো না।

দেশ একদিন স্বাধীন হয়েছে। ত্রিশ লাখ শহীদদের রক্ত, লাখো মায়ের 'সম্ভ্রম' আর প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অবর্ণনীয় ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে। এমন হাজারো না বলা অব্যক্ত ধ্বনি এখনো প্রতিধ্বনিত হয় মুক্তিকামীদের পরিবারে।

যুদ্ধ শেষ হলেও এই মহিয়সীর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তখনই। একেক করে পাঁচটি সন্তান জন্ম দিয়ে মানুষ করার প্রাণান্তকরণে চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার এই সাতচল্লিশ বছর পেরিয়ে দেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম উঠিয়েছে সেখানে অবদান আছে ষোল কোটি মানুষের, তাদেরই একজন এই নারী।

মুক্তিযুদ্ধে স্বামী নির্ভার হয়ে স্বাধীনতার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন এমন একজন সহধর্মিণী ছিলেন বলেই। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে, তার অনুপস্থিতিতে পালিয়ে বেড়িয়েও অবরুদ্ধ অঞ্চল থেকে মুক্তিকামীদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়েছেন তবুও হাল ছেড়ে দেননি সেদিন।

কখনো গর্ব করেন না। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান জাহির করেন না। সাদাকালো জীবন ভালো লাগে তার। প্রিয় রং লাল সবুজ।

তিনি হোসনে আরা ইদ্রিস মুক্তা।

এই নারীর গর্ভে জন্ম নিয়ে আমি ধন্য। কোন প্রকারের রাষ্ট্রীয় সুবিধা চাই না, তবে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মানটুকু চাই।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত