মুক্ত করো হে শৃঙ্খল
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৮, ০২:৪৩
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। শ্রমজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে মূলত দিবসটির উদ্ভব। দিনটি সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় বহু সভা-সমাবেশ-সেমিনার। সেখানে নারীর প্রতি নির্যাতন-সহিংসতা বন্ধের কথা বলা হয়। কিন্তু আদৌ কি তা বন্ধ হচ্ছে বা বিন্দুমাত্র কমেছে? নাকি দিন দিন বেড়েই চলছে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন?
এই দিবসের পেছনে রয়েছে শ্রমজীবী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে সেলাইকলের হাজার হাজার নারী শ্রমিক ন্যায্য মজুরি ও ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনরত বহু নারী শ্রমিককে পুলিশের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আবার নিউইয়র্ক শহরের পূর্বপ্রান্তে হাজার হাজার নারী শ্রমিক শিশুশ্রম বন্ধ ও ভোটাধিকারের দাবিতে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন। ইতিহাসে যা ‘বিশ হাজারির উত্থান’ (আপরাইজিং অব টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড) নামে খ্যাত। ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কনফারেন্সে জার্মানির কমিউনিস্ট নেত্রী কমরেড ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেন এবং সেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে বামপন্থিরা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। দীর্ঘদিন পর ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ছাড়াও বিভিন্ন মতের মানুষ এ দিবসটি পালন করতে শুরু করে।
সেদিনের আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর আর আজকের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে তেমন কি কোনো পার্থক্য আছে? বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি নারী শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে বেঁচে আছে এদেশের জণগণ। কৃষি ক্ষেত্রেও নারীরা অবদান রাখছে। আমাদের ঘুম ভাঙার আগে রাস্তাটি পরিস্কার করে, সেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীও অনেকে নারী। সন্তানের জন্ম দেয়া ও তাদের প্রতিপালন করা, গৃহস্থালির কাজে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পাশাপাশি নারীরা কলে-কারখানায়ও দিনের পর দিন কাজ করে থাকে। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে মহাকাশের অভিযানেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখছে। কিন্তু এখনো নারীর প্রতি বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা কমেনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে। দেশের ৮৭ ভাগ নারী নিজ গৃহে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণ, নানা ধরনের নির্যাতনের খবর দেখে আমাদের শিউরে উঠতে হয়।
নারীকে বন্দি করার একটা ইতিহাস আছে এবং সে ইতিহাস বলে যেদিন থেকে সমাজে শ্রেণি শোষণ এসেছে সেদিন থেকে নারী জাতি বন্দি হয়েছে। সমাজে শোষণের এ ব্যবস্থা নারীকে উৎপাদনশীল কাজ কর্ম থেকে সরিয়ে দিয়ে গৃহ কর্মের দিকে ঠেলে দিয়েছে। শ্রেণি শোষণের সাথে নারী জাতির শোষণ, নিপীড়ন ও পরাধীনতা অবিচ্ছেদ্য। যেদিন সমাজে শোষণ থাকবে না, সেদিন নারী জাতির বন্দিত্বও থাকবে না।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা কেবল নারী পুরুষে বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। বৈষম্য সৃষ্টি করেছে মানুষে-মানুষে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে। ব্যক্তি মালিকানা নির্ভর পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানা নির্ভর ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’ সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই সমাজের সকল ধরনের শোষণ বৈষম্যের অবসান ঘটবে।
মহামতি লেনিন বলেছেন, ‘অত্যাচার ও অত্যাচারীদের মধ্যে, শোষক ও শোষিতের মধ্যে কখনো সাম্য হতে পারে না। যতক্ষণ না পুরুষের আইনগত সুবিধা থেকে নারী স্বাধীনতা পাচ্ছে, যতক্ষণ না পুঁজির কবল থেকে শ্রমিক স্বাধীনতা পাচ্ছে, যতক্ষণ না জমিদার বণিকের দাসত্ব থেকে কৃষক স্বাধীনতা পাচ্ছে ততক্ষণ প্রকৃত স্বাধীনতা হতে পারে না। তাই আমাদের লক্ষ্য বুর্জোয়া নারী আন্দোলন নয়, বুর্জোয়া সমাজে কিছু দাবি দাওয়া আদায় নয়, আমাদের লক্ষ্য পরিপূর্ণ নারীমুক্তি।’
পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে বিলাসদ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টিশীল সত্তা বিকাশের প্রশ্নে নারীকে দ্বৈত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে নামতে হয়। শ্রমিক হিসেবে তার লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে এবং নারী হিসেবে লড়াই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। তবে পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজির শ্রমদাসত্ব থেকে নারীমুক্তির এই লড়াই শুধুমাত্র কারখানাভিত্তিক কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায় কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা বিরোধী কিছু নারীবাদী শ্লোগানের মধ্যে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং মানুষ হিসেবে নারীমুক্তির এই লড়াইয়ের আঘাত পরিচালনা করতে হবে গোটা পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাই একদিকে পুঁজির শোষণ অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের দাসত্ব থেকে গোটা সমাজকে মুক্ত করতে না পারলে নারীর প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।
নারীমুক্তির সংগ্রাম কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও। গণতন্ত্র, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে অগ্রসর করে নিতে নারীমুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে। মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ হচ্ছে নারীমুক্তি আন্দোলন। নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত মানবমুক্তির সংগ্রাম হবে না। নারীমুক্তির বিষয়কে অগ্রাহ্য করে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি অসম্ভব। নারীমুক্তির পথ ধরেই মানবমুক্তির পথে অগ্রসর হতে হবে। নারীমুক্তি কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারীরা অংশগ্রহণ করবে। কেবলমাত্র তেমন অবস্থাতেই নারীরা সমাজে পুরুষের সমান স্থান পাবে। তাই সভ্যতার বিনির্মাণে, সমাজপ্রগতির অপরিহার্য অংশ হিসেবেই নারীমুক্তি আন্দোলনকে অগ্রসর করতে হবে। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারী মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়।
পরিশেষে বলতে হয়, ১০৮তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনে নারীর প্রতি সকল অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য দূর করা, সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন করা ইত্যাদি মূল দাবির পাশাপাশি নারীর ওপর প্রাত্যহিক নিপীড়ন, নৃশংসতা, ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতন, সরকারের কৌশলী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে দিয়ে, মৌলবাদী, হেফাজতিদের নিকট আত্মসমর্পণ, ফতোয়া, এসিড-সন্ত্রাস, অপহরণ, বিদেশে পাচার, যৌতুক ও সাইবার ক্রাইমের শিকার ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রয়োজন আপোসহীন লড়াই।
আমরা ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের ডামাডোলে শোষিত, নিপীড়িত নারীদের কথা যেন ভুলে না যাই। শুধুমাত্র দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিদিনই হোক আমাদের অধিকার আদায়ের দিন।
লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা ও সাংবাদিক