শায়লাকে বেশ্যা না বললেও চলে
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:২৪
২৩ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ জানুয়ারি আন্দোলনরত এক নারীর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যানারে ভিসিকে আটকে রাখে। যেহেতু ইতিহাসের প্রত্যেকটি আন্দোলনে সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন- প্রগতিশীলরা। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। মূল নেতৃত্বে ছিলো- ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি) সহ প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ছাত্রসংগঠনগুলো। সকাল থেকেই তারা অবস্থান করছিল। ভিসিকে আটকে রেখেছিল। প্রক্টর একটি অনুষ্ঠানে যাবে বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জানালেও তারা তাকে মুক্ত করে দেয় নি। তাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তারা প্রক্টরকে আটকে রাখবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপরে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। যে হামলার মূল নেতৃত্বে ছিলো সন্ত্রাসী দলের সাধারণ সম্পাদক। কয়েক’শ ছাত্রলীগ মিলে কয়েকজন আন্দোলনকর্মীর উপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। যেখানে ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীর সাথে যুক্ত হয়েছিল নারী নেতাকর্মীরাও। এমনি একজন নারী নেত্রী শায়লা শ্রাবণী। কুয়েত মৈত্রী হলের নেত্রী। ক্ষমতাসীনদের দল করে, তার তো পাওয়ার থাকবেই! থাকাটাই স্বাভাবিক! যদি তাই না থাকতো তবে কি আর নেত্রী হতে পারতো! এখন পাওয়ারেরও শ্রেণীচরিত্র আছে। আমাদের আন্দোলনরত ছাত্রীদেরও পাওয়ার আছে। তাদের পাওয়ারটা হলো জনগণের পাওয়ার, মানুষের ভালোবাসার পাওয়ার। আর শায়লার পাওয়ার ক্ষমতার পাওয়ার, অর্থের পাওয়ার। সহজ হিসাব।
শায়লাকে আমি বেশ্যা বলতে পারছি না, শায়লা কাপড় খুলে ফেলুক তাও বলতে পারছি না। কেননা, শায়লা আর প্রগতি বর্মণ তমাদের পার্থক্য বুঝতে হবে। এই যে, শায়লা এত কিছু করলো, চুল ছিঁড়ে ফেললো, ওড়না টেনে নিয়ে গেল, লাথি, ঘুষি, চড় মারলো। তবুও, আমাদের তমারা শায়লার ওড়না টেনে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিবে না। তমারা জানে নোংরা রাজনীতিতে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ টেনে লাভ নেই। এখানে দুটো শ্রেণী একটা নিপীড়িত আর একটা নিপীড়ক। এর বাহিরে আর কিছু নেই। আমার বন্ধুরা দেখছি শায়লাকে কাপড় খুলে ফেলার পক্ষে মত দিচ্ছে, তাকে উলঙ্গ করলে কেমন লাগবে তা জানতে চাচ্ছে, তাকে উলঙ্গ করে তাদের সামনে ছেড়ে দিক- তাও বলে বেড়াচ্ছে। এমনও বলে বেড়াচ্ছে- পতিতারা শুধু পতিতালয়ে থাকে না, ঢাবিতেও থাকে, ছাত্রলীগেও থাকে। এগুলো কি ধরনের নোংরা মানসিকতা? শায়লাকে আক্রমণ করার আর কোনো পথ নেই?
শায়লাদের শ্রেণীচরিত্র বুঝতে হবে। হাসিনা তো দেশের প্রধানমন্ত্রী, নারী প্রধানমন্ত্রী। তাতে কি হয়েছে নারীদের? কারণ তার শ্রেণীচরিত্র নিপীড়িতের পক্ষে নয় নিপীড়কের পক্ষে। এই যে এতকিছু ঘটে গেল ‘মাদার অফ হিউমানিটির’ কোনো কথা নেই। উনি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। এদেশে তমাদের শ্লীলতাহানি অতো সস্তা নয়। তমা, আশারা বেঁচে থাকার সুখটা বুঝে গেছেন। তারা বুঝে গেছেন আন্দোলন ব্যতীত আর রক্ষা নেই। এই সমাজকে শ্রেণীহীন সমাজ হিসেবে গড়ে না তোলা পর্যন্ত তমা, আশাদের কারো মুক্তি নেই।
শায়লার রাজনীতি নিয়ে আপনি হাজারটা কথা বলেন। কিন্তু নারী হওয়ার কারণে তাকে বেশ্যা বলে, মাগি বলে, খাঙ্কি বলে আখ্যায়িত করতে পারেন না। লিটনকে যারা অর্ধউলঙ্গ করে ফেললো তাদেরকে কি বলবেন? দুটো শ্রেণীই যথেষ্ট। নারী, পুরুষ ভেদাভেদ টেনে মজা পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শায়লার রাজনীতি ওকে যা শিক্ষা দিয়েছে ও তাই করেছে। দেখেন, তমা, আশারা কিন্তু ওর ওড়না টেনে নেয় নি, ওর কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে, চিল্লাচিল্লি করেছে। তার মানে কি এটা বুঝা যায় তমাদের শক্তি নেই, দুর্বল শ্রেণীর? মোটেও না। তমাদের আদর্শ অনেক বড়। তাদের দর্শন তাদেরকে শিক্ষা দেয় নারীমুক্তির, মানবমুক্তির। তাই তো তারা শায়লাদের চুল ছিঁড়তে পারে না, ওড়না টেনে নিয়ে উলঙ্গ করে দেওয়ার মানসিকতা অর্জন করতে পারে না। তবে প্রতিরোধটা করতে পারে। প্রয়োজনে জীবনও দিতে পারে। ইতিহাস তাই বলে। ইতিহাসের শিক্ষাই বড় শিক্ষা।
আমি মোটেও শায়লার পক্ষ নিচ্ছি না। অন্যায়কে অন্যায় বলার মতো মানসিকতা আমার আছে। আমার রাজনৈতিক শিক্ষাও তাই। শায়লা এখানে ব্যক্তি মাত্র। বড় বড় শায়লারাও এই নোংরামী করবে। কেননা তাদের কোনো আদর্শ নেই, নীতি-নৈতিকতা নেই, দর্শন নেই। তাদের দর্শন খুনের, রাহজানির, চুরি, বাটপারির। সুতরাং, এটা এই নোংরা রাজনীতির ফসল।
যে বা যারা শায়লা এই বেশ্যাগিরি করেই পদ-পদবী পেয়েছে বলে বেড়াচ্ছেন, তাদের বলতে চাই- নারী হওয়ার কারণেই বেশ্যা বলছেন কেন? বেশ্যা শব্দটা উইথড্র করেন। শায়লাকে রাজনীতি দিয়ে আঘাত করেন। আপনার রাজনৈতিক নৈতিকতা দিয়ে আঘাত করেন। শায়লার ব্যক্তিগত ছবি অর্ধনগ্ন করে আপনারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন? শায়লার স্তন ধরে টানা উচিত বলে কি বুঝাচ্ছেন? কি জঘন্য মানসিকতা! কী ভয়ংকর! একটা অন্যায়কে অন্যায় বলতে গিয়ে আরেকটা অন্যায় করে বেড়াচ্ছেন! এ কেমন শিক্ষা!
শায়লাকে বহিষ্কারের দাবি তোলেন, জনগণের কাছে তার ভুল স্বীকার করে যাতে ক্ষমা চায় সে কথা বলেন, শায়লাদের আর যাতে ভুল না হয় তা বলুন। আমি মোটেও শান্ত হতে পারছি না। আন্দোলনে এত এত লোক হামলা করলো। অথচ আপনারা শায়লাকেই দেখছেন, শায়লাকেই ধর্ষণ করার মানসিকতা প্রকাশ করে বেড়াচ্ছেন। আমি সরি। এই মানসিকতা বর্জন করুন। কোনো আন্দোলনকর্মী কিন্তু এই মানসিকতার প্রকাশ ঘটাতে পারছে না। যারা মার খেয়ে হাসপাতালে তারাও কিন্তু এ ধরনের নোংরামী করতে পারছে না। তবে আপনারা কেনো? আপনারা কেনো সুযোগের অসৎ ব্যবহার করছেন? শায়লারা এই নোংরা সিস্টেমের নোংরামীর অংশ। নোংরামী নিয়ে আওয়াজ তুলুন। ব্যক্তি শায়লাকে আক্রমণ করে, কথা দিয়ে ধর্ষণ করে কোনো লাভ হবে না। বরং শায়লাদের সংখ্যা বাড়বে।
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট