খসখসে স্বভাবের মা
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:০০
যে মায়েরা খুব খ্যাচখ্যাচ করে তাদের ছোটবেলায় ভাল লাগতো না। এখন ভালো লাগে। খুব বেশি ভালো লাগে। 'ডুব সাঁতার' দেখে আমি ওয়াহিদা মল্লিক জলিকে নিয়ে ভাবতে বসলাম। তিনি কেন এরকম খসখসে স্বভাবের। কেন আরেকটু নরম কোমল, আরেকটু পরিপাটি নন?
এই মায়েরা কতটা চাপে পড়ে এইরকম খ্যাচখ্যাচে স্বভাবের হয়ে যায় এগুলো তারা কখনো কাউকে বলতে পারেন না। তারা নিজের উপরে সব কষ্ট চাপিয়ে পাশের কাউকে বলতে চান না যে তার কষ্ট হয়। একা একা এতোগুলো মানুষের দায়িত্ব নিয়ে একটা মানুষ নিজে ভালো থাকতে পারে না কথাগুলো কাউকে না বলেই প্রতিদিন তারা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘুমাতে যান।
সিঙ্গেল মাদার ফ্যামিলিতে জন্ম বলে দেখেছি সকালে উঠে মাকে স্কুলের জন্যে খাবার তৈরি করে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। বাচ্চা ছিলাম তো বুঝে উঠতে পারি নি অতো সকালে উঠে কারও কাজ করতে ভালো লাগে না। মেয়ে বলেই টের পাই মাসের স্পর্শকাতর দিনগুলো আমার কাজ করতে অনিহা লাগে, কেমন বমি বমি পায় সব সময়। এই মানুষটাকে দেখে কখনো মনেই হয় নি তারও এই দিনগুলো আসতো কোনদিন। মাসিক নিয়ে খুব বিছানা ঘেঁষে থাকলে মা খুব গালাগাল দিতেন। "মেয়ে হয়ে জন্মেছ এগুলো নিয়ে চলতে হবে না? এইরকম পড়ে থাকলে হবে?" আমি বুঝতাম না মা কেন এইরকম গালাগাল দিতেন। মা কেন আমাকে একটু নরম করে কথা বলে না? আমাকে কেউ বলে নি, আমার মাকেও কেউ নরম করে কথা বলত না, বলে নি কখনো। মা খুব ভয় পেতো তাই। কেউ হয়তো নরম দেখলেই পিষে ফেলবে- সেই ভয়। এই ভয় মাকে খুব আগ্রাসী করে ফেলতো মাঝেমাঝে।
মা যখন মারতেন পৃথিবীর সমস্ত আগ্রাসন পিঠের উপরে চালাতেন। বুঝতাম না একটা মানুষ অমন করে কেন মারতেন বাচ্চাগুলোকে? মায়ের কেনা থাকতো জোড়া বেত। বেতগুলো পানিতে ভেজানো থাকতো সবসময়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আমার পিঠের উপরে দুটো কচকচে বেত যেদিন ভাঙা হয় আমি সাতদিন নড়তে পারি নি ব্যথায়। আমাকে কেউ বলে নি মায়ের উপরেও পৃথিবীটা অমনই আগ্রাসী ছিল। ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে সমস্ত সুখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীকে আপন করে নিতে কেউ তাকে বলে নি। তিনি করেছিলেন। কেন করেছিলেন জানি না। নিজের জীবন নিজের মত করে সাজিয়ে নিলে হয়তো আমরা জলে ভেসে যেতাম। এক জীবন উৎসর্গ করে তবু দুটো জীবন বেঁচে থাক।
ছোটবেলায় একবার এক মা মাকড়সাকে খুব খুঁচিয়েছিলাম ডিমটা আলাদা করে ফেলার জন্যে। মাতৃত্ব কী জিনিস বুঝি নি। বুঝলে হয়তো জানতাম জান থাকতে ঐ ডিমটা সে ছাড়বে না।
ছোটবেলায় খুব রাগ হত মায়ের উপরে। কেন খ্যাচখ্যাচ করেন? কেন আমার সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলেন না, কেন শুধু খাবার খাইয়েই তার শান্তি হয়? আমি তো মনের ক্ষুধায় মরে যাচ্ছিলাম তখন। আমি চাইতাম সবসময় আমার মা আমার সাথে বই নিয়ে কথা বলুক।
একই মা আমার মা, বাবা, গৃহকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক সব। একজন মানুষ এতো সব কাজ করলে তার নিজের জন্যে বেঁচে থাকার কোন সময় থাকে না। তাদের নিজেদের জন্যে কোন সময় রাখা ছিল না। তারা কারো জন্যে ছুটতে ছুটতে এক সময় টের পান নিজেদের জন্যে কিছুই করা হয় নি।
আমি বুঝতাম না পৃথিবী এই মায়েদের ছাড়তো না তার এক কণাও। পাই পাই করে শোধ তুলে নিতো তাদের কাছ থেকে। মা হবার শোধ, মেয়ে হবার শোধ!
[উৎসর্গ - মা মিলীয়া চৌধুরী এবং জেসমিন চৌধুরীকে একসাথে। যিনি ঘুরে দাঁড়ান নি এবং যিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, বায়োলজিক্যাল এণ্ড লজিক্যাল এই দুজনকেই প্রচণ্ড ভালোবাসি মেয়ে হিসেবে]
লেখক: জাবি শিক্ষার্থী