ধর্ষণে নারীদের মিথ্যা দায়: নতুন বছরে একটি আশাবাদ
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪৫
'মেয়েটাকে আনো, মেয়েটাকে আনো'- বহু পুরোনো একটি ফরাসি প্রবাদ। এর অর্থ- যা কিছু দুর্যোগ, দুর্ঘটনা- তার পেছনে একটি মেয়েই দায়ী। তাই সেই মেয়েটাকেই খোঁজো। পুরুষতন্ত্র এমন কথা বহুবার, বহুরূপে বলে এসেছে, এখনও বলে; নানা দেশে, নানা উপায়ে। মনে পড়ছে- পাকিস্তানে একবার ভূমিকম্প হলে এক মাওলানা সাহেব কি বলেছিলো। সে দেশের জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলামির নেতা ফজলুর রহমান বলেছিলো- মেয়েদের জিন্স প্যান্ট পরাই ভূমিকম্পের জন্য দায়ী। মুদ্রাস্ফীতির জন্যও মেয়েদের জিন্স প্যান্ট পরা দায়ী। এই মূর্খ ধর্মীয় নেতাটি মেয়েদের ঘরে বন্দী রাখতে পাকিস্তান সরকারের কাছে মিলিটারি পদক্ষেপ চেয়েছিলো। আমাদের আশ্চর্য লাগতে পারে এই আচরণ, আমরা ঘর কাঁপিয়ে হাসতেও পারি, কিন্তু আমাদের আপাত- আধুনিক শিক্ষিত মানসিকতা আসলেই কি আধুনিক এবং যুক্তিবাদী?
একটি মেয়ে ধর্ষণ বা যেকোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হলে আমাদের অনেকেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে মেয়েটির কোনো দোষ ছিলো কি না। নির্যাতনের শিকার মেয়েটি কোনো ধরনের আহ্বানমূলক আচরণ (Provocative behaviour) করেছিলো কি না, মেয়েটি কি পোশাক পরেছিলো, মেয়েটি কোথায়, কখন গিয়েছিলো- সবই আমাদের দৈনন্দিন গবেষণার চর্চা হয়ে দাঁড়ায়। এতে যে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধ হালকা হয়ে যায়, এসব চর্চা যে অপরাধীকে এক ধরনের অনৈতিক মানসিক সমর্থন দেয়- সে কথা আমরা ভেবে দেখি না। কিংবা ভেবে দেখি, ভেবেই দায়ী করার চেষ্টা করি নির্যাতিতাকে, কারণ এ সবই পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা, যে কুশিক্ষা আমরা বহুযুগ ধরে বহন করে চলেছি।
মিকি কেনডাল, একজন আমেরিকান কলামিস্ট। তার একটি লেখা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছিলো ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ তে। 'Why dress codes can't stop sexual assault'- এই শিরোনামের লেখাটিতে তিনি গবেষণাভিত্তিক কিছু তথ্য পরিবেশন করেছেন। A Federal Commission of Crime of Violence -এর গবেষণায় দেখা যায়- ২২ শতাংশ খুন নিহতের উত্তেজক ব্যবহারের জন্য কিয়দংশে দায়ী, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র ৪.৪ শতাংশ, তাও প্রমাণিত নয়। এই তথ্যটিও কৌতূহলোদ্দীপক- শাস্তি পেয়েছে, এমন অধিকাংশ ধর্ষক মনেই করতে পারেনি তাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারী কি ধরনের পোশাক পরে ছিলো। ১৯৯৯ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের জন্য পোশাকের দায়কে মুক্তি দিয়েছে। মিকি কেনডালের পরিবেশিত তথ্যে এটাও উঠে এসেছে- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের বেলায় স্থানটি হয় নারীর পরিচিত, ধর্ষক হয় নারীর পরিচিত। তাই নারী কখন, কোথায় যাচ্ছে- সেটি ধর্ষণের পক্ষে যুক্তি হতে পারে না।
মিকি কেনডালের লেখার সমর্থন পেয়েছি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের গবেষণায়। 'মিথ' ও 'ফ্যাক্ট'- এইরকম ভাবে ভাগ করে তারা দেখিয়েছে- ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলি কি এবং আসল সত্য কি। যেমন: প্রচলিত ধারণা হচ্ছে- নারী যখন যৌনউত্তেজক পোশাক পরে, সেটি ধর্ষণকে আমন্ত্রণ করে। আর সত্য হচ্ছে এই- ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন অপরাধ। কোনো ধরনের পোশাক অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণের দায় কমায় না। এমন আচরণ যৌন নির্যাতন এবং এটি শাস্তিযোগ্য। আরেকটি প্রচলিত ধারণা- নারী যদি কোনো পুরুষের আমন্ত্রণে তার নির্জন বাড়িতে কিংবা পার্টিতে যায় এবং সেখানে সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে নারীটিরও কিছু দায় আছে। আর সত্য হচ্ছে- নারী যেকোনো সময়, যেখানেই যাক না কেন, তার অসম্মতির বিরুদ্ধে যেকোনো যৌন আচরণ অপরাধ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- এসব আমেরিকান গবেষণা ও তথ্যে আমরা আস্থা রাখবো কি না। অন্তত আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বলয়ে। আমাদের তো ধর্মগ্রন্থ আছেই নানারকম যেগুলো নাকি সকল সামাজিক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তার একটি লেখায় বলেছেন- "যখনি কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।…আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।"।
বেগম রোকেয়ার কথা থাক। আপনি ব্যক্তিগত জীবনে কতটুকু ধর্ম মানবেন, পরিবারের সদস্যদের কি উপদেশ দেবেন, সে আপনার ব্যাপার। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে- প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ আপনার পরিবারের সদস্য হলেও তাকে কোনো বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে, তাকে আপাদমস্তক ঢাকতে আপনি বাধ্য করতে পারেন না। আপনার উপদেশ দেয়ার অধিকার আছে, বাধ্য করার নেই। আর যখনই কেউ ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের জন্য পোশাক, আচরণকে দায়ী করে, সেটি পুরুষতন্ত্রের নোংরা বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই হয় না।
বলছিলাম ধর্ষণে নারীদের দায়, যেটি মিথ্যা, যার কোনো মানে হয় না- তাই নিয়ে। খুন বা ডাকাতির ক্ষেত্রে শিকারের দায় দেখা হয় না, খোঁজা হয় না, অথচ ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে সমাজ দায় খোঁজে নারীটির। এই দায় খোঁজার বীভৎস ব্যাপারটি বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইন দ্বারাও স্বীকৃত।
এই আইনের ১৫৫(৪) ধারায় আছে: "The credit of a witness may be impeached in the following ways by the adverse party, or, with the consent of the Court, by the party who calls him: (4) When a man is prosecuted for rape or an attempt to ravish, it may be shown that the prosecutrix was of generally immortal character."
অনুবাদ: "নিম্নলিখিত উপায়ে বিরুদ্ধ পক্ষ বা আদালতের অনুমতি নিয়ে সাক্ষী আহ্বানকারী পক্ষ সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা অভিশংসিত/নষ্ট করতে পারে: (৪) কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।"
অর্থাৎ নিগৃহীতা নারীটির যদি চরিত্র খারাপ হয়, তাহলে অপরাধীর দায়মুক্তির একটি পথ সাক্ষ্য আইনের এই ধারায় করেই দেয়া আছে। এমনকি ধর্ষকও রেহাই পেয়ে যেতে পারে।
কল্পনা করুন আদালতের একটি জনাকীর্ণ কক্ষ, যেখানে ধর্ষকের আইনজীবী বারবার সকলের সামনে ধর্ষিতা মেয়েটির চরিত্র নিয়ে নোংরা কথা বলে যাচ্ছেন, আর মেয়েটি সকলের সামনে দাঁড়িয়ে এসব শুনতে বাধ্য হচ্ছে। আইনে কিন্তু চরিত্রের সংজ্ঞা দেয়া নেই। 'দুশ্চরিত্রা' শব্দটি নারীর জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই আইনে। তবে, আমার সরল বিবেচনা যা বলে, গৃহবধূ হোক বা কৃষাণী, ছাত্রী হোক বা চাকরিজীবী, শ্রমিক হোক বা গার্মেন্টস কর্মী, সচ্চরিত্রা হোক বা দুশ্চরিত্রা, ধর্ষণ বা বলাৎকারের অপরাধ কারো ক্ষেত্রেই লঘু হয়ে যায় না। এমনকি যৌনকর্মীও যদি সম্মতি না দেয়, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমও ধর্ষণের আওতাভুক্ত হওয়া উচিত।
'সম্মতি'- এটি অনেক গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের স্বাধীনতা কেবল ঐ মানুষটির, অন্য কারো নয়। 'না' মানে না, এর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
নতুন বছরে এই আশাবাদ জানাচ্ছি- ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের জন্য নারীর দায় খোঁজার খেলা বন্ধ হবে, বিলুপ্ত হবে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা। পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মন হয়ে উঠুক সুস্থ পুরুষ এবং সুস্থ নারীর। পুরুষতান্ত্রিকতাকে জয়ী করার জন্য সামাজিক নিয়ম ও ধর্মের হাতিয়ার প্রয়োগ বন্ধ হোক।
লেখক: চিকিৎসক