ইভটিজিং: সমাজ ধর্ম ও পরিবারের দায়
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০১৬, ০০:২১
ইভ টিজার মানে নারী উত্যক্তকারী জন্মের জন্য দায়ী সমাজ ধর্ম ও পরিবার। যখন সমাজ বলে যে "একজন নারী রাতে একা বের হতে পারবে না"। যখন সমাজ বলে "ভালো মেয়েরা রাতবিরেতে বাইরে যায় না"। তখন প্রকারান্তরে সমাজই নারী নিপীড়নে বা নারী উত্যক্ত করতে পুরুষের একটা অংশকে লাইসেন্স দিয়ে উৎসাহী করে তোলে। কারণ নারী উত্যক্তকারী পুরুষটি জানে তার কুকর্ম জানাজানি হলে সমাজই তার রক্ষকের ভূমিকায় এসে আগে প্রশ্ন তুলবে যে "মেয়েটি কেনো একা বের হলো, রাতে ভালো মেয়েরা একা বাইরে যায় না"। এই কথিত "ভালো মেয়ে" শব্দটা ব্যবহার করেই সমাজ প্রমাণ করতে চাইবে যে মেয়েটির চরিত্র খারাপ অর্থাৎ মেয়েটি পতিতা, আর আমাদের সমাজে আবার পতিতার সম্মান কিসের? একবার কোন নারীর গায়ে পতিতা শব্দটা জুড়ে দিতে পারলেই পুরুষের পোয়াবারো, তখন সেই নারীকে কেবল উত্যক্ত নয় বরং ধর্ষণ করাও জায়েজ হয়ে যায়। তাই ধর্ষক বা নারী উত্যক্তকারীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দায়।
যখন ধর্ম বলে যে নারী কেন পর্দার বাইরে যাবে, বা নারী কেন ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবে, তখন সেই সামাজিক প্রভাবের মতোই নারী নিপীড়নকে বৈধতা দিয়ে দেয় ধর্ম। কারণ ধর্ষক বা নারী উত্যক্তকারী জানে যে নিপীড়িত নারী যদি প্রতিবাদ করে তবে ধর্ম সেখানে মোড়লের ভূমিকায় এসে সেই নিপীড়িত নারীটিকে পর্দার বাইরে বা ঘরের বাইরে যাবার দায়ে দোররা মারতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। নারীকে গৃহবন্দী করতে ধর্ম বা সমাজের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হচ্ছে নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ। কারণ নারীর মাথায় যদি সতীত্ব নামক কনসেপ্ট ডুকিয়ে দিয়ে তাকে সারাক্ষণ আতঙ্কিত করে রাখা যায় তবেই নারীরা ঘরের কোণে লুকাবে। আর নারীদের প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ কেমন সেটা জানতে হলে ধর্ম প্রচারকারী ধর্মগুরুদের দুইচারটে আলোচনা শুনলেই বোঝা যায়। তাই নারী নিপীড়ন মুক্ত নারীবান্ধব সমাজ গড়তে আগে প্রয়োজন নারী বিদ্বেষী ধর্মীয় মতবাদ প্রচার বন্ধ করা।
অনেক সময় বলা হয় "সন্তান অপরাধ করলে বাবা মায়ের দায় কি? কোন বাবা মা কি চায় তার সন্তান খারাপ হোক কিংবা বাইরে গিয়ে সন্তান অপরাধ করলে সেটা বাবা মা কিভাবে জানবে?" আপনার সন্তানকে পোশাক কিনে দেবেন আপনি, খাইয়ে পড়িয়ে সন্তানকে শক্তিশালী করে তুলবেন আপনি, সন্তানকে মোটরবাইক কিনে দেবেন আপনি, সন্তানের মোটরের জ্বালানী খরচ দেবেন আপনি, তারপর আপনার সন্তান আপনার কিনে দেয়া বাইকে চেপে রাস্তায় মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করবে, মেয়েদেরকে অশ্লীল বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে উত্যক্ত করবে আর আপনি তার দায় নেবেন না কেন? আগে নিশ্চিত হোন যে আপনি আপনার সন্তানকে সভ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পেরেছেন কিনা, তারপর সন্তানের সাধ আহ্লাদ পূরণ করুন। কারণ সন্তানের প্রতি আপনার অতি বিশ্বাস আর অতি ভালোবাসাও হতে পারে আপনার সন্তানকে অপরাধপ্রবণ করে তোলার কারণ। তাই ‘আমার ছেলে অন্য ছেলেদের মতো না, আমার ছেলে অনেক ভদ্র লক্ষ্মী’ এসব আদিখ্যেতা বাদ দিয়ে সন্তানের প্রকৃত মানসিক অবস্থা জানতে চেষ্টা করুন। চেষ্টা করুন তাকে মানবিক শিক্ষা দিতে।
আমরা কথায় কথায় নারী স্বাধীনতা, নারী মুক্তি, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার ইতিবাচক বয়ানের ফুলঝুরি ফোটাই কিন্তু নারীর প্রতি সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন না করে কখনোই নারী নিপীড়ন বন্ধ করা সম্ভব না। আমাদের রাষ্ট্র কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহনের কথা বলবে আবার এই রাষ্ট্রেই আয়োজন করে প্রকাশ্যে কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে গান গাইবে, ‘‘সাবধানে থাকিও নারী পর্দার আড়ালে, হাদিসে হারাম লেখে অন্যে দেখিলে’’।
এমন দুমুখী রাষ্ট্রীয় নাটক বন্ধ করতে হবে যদি রাষ্ট্র তার বয়ানের মতোই বাস্তবিকভাবে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কর্মক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ আশা করে।
লেখক: পরিচালক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট