কন্যা সন্তানের পিতা
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৪১
দ্বিতীয় সন্তানের যখন জন্ম হয়, তখন অপারেশন থিয়েটারে একজন স্বজন অ্যালাও করেছিলেন কর্তৃপক্ষ আমার অনুরোধে। আমি এগিয়েও যাচ্ছিলাম, মা বললেন, আমি যাচ্ছি। কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এলেন নাতনী সমেত, মুখমণ্ডলে কিঞ্চিৎ উদাসীনতা! মনে মনে একজন নাতি প্রত্যাশা করেছিলেন হয়তো। কাজের চাপে মা আমার সাথে থাকেন না। আমার দ্বিতীয় মেয়েটি যখন আড়াই বছরে পড়লো, তখন আমি বিছানায় ঘুমোতে গেলে বালিশের উপর আধশোয়া হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো মায়ের মতোই, যেন আমি তার সন্তান। চোখে পানি চলে আসতো কখনো কখনো, ওর ভালোবাসার আদর পেয়ে। মায়ের অনুপস্থিতির শূন্যতা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে সে।
পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে আমার অবস্থান চতুর্থ। আমার জন্মের আগে পাড়া পড়শি, আত্মীয় পরিজন আকারে ইঙ্গিতে আমার মাকে কটু কথা শুনিয়েছেন। আমার কোন বোনের সাথে কাকে বিয়ে দিয়ে সহায় সম্পদ কিভাবে নিজেদের মধ্যে রাখা যায়, তাই নিয়ে মুটামুটি একটা পরিকল্পনাও ছিলো প্রায় চূড়ান্ত। আমার জন্ম পাল্টে দিয়েছিলো সব হিসেব নিকেশ। অনেকেরই চোখে মুখে তখন রাজ্যের হতাশা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটাই হয়তো বাস্তব চিত্র।
একজন পরিচিত স্বজন, যার দুটি কন্যা সন্তান। একদিন খুব মন খারাপ করে বলছিলেন, সহায় সম্পদ যা আছে সব ভোগ করে যাবো, তা না হলে সবই উপভোগ করবে মেয়ের জামাইরা। ছেলে নেই এমন পিতার কন্যার খোঁজে আছে হয়তো অনেক লোলুপ জামাই-শ্বশুর। সমীকরণটা এখানে স্পষ্ট।
যারা পুত্রহীন, তাদের কেউ কেউ অন্তরজ্বালায় পুড়ছেন সত্য। এর মূলে রয়েছে আমাদের প্রগৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক প্রত্যাশা। একজন পিতা কিংবা মাতা কোন ভাবেই তার সন্তানদের আলাদা চোখে দেখেন বলে আমার মনে হয় না। একজন দাদা কিংবা দাদী নাতির স্বপ্ন দেখতেই পারেন, মা কিংবা পিতাও পুত্র চাইতে পারেন, এতে অন্যায় কিছু দেখছি না। তবে কেউ কেউ আছেন যারা, ভ্রূণ অবস্থাতেই কন্যা সন্তানকে হত্যা করেন। দেশের আনাচে কানাচে অনেক অবৈধ ক্লিনিক বা সেবাকেন্দ্র আছে, যেখানে অনৈতিক এই সুবিধা দেয়া হয়। তাহলে সেই যুগের সাথে আমাদের এই সময়ের পার্থক্যটা রইলো কোথায়, যেখানে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত মাটি চাপা দেয়া হতো।
কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার অনেক যন্ত্রনাও আছে। আমি জন্ম দিয়ে, সময়, শ্রম (অর্থের কথা এখানে উল্লেখ করলাম না, তা না হলে এটাও বলা হতে পারে, আমাদের মানসিকতা ছোট) ও গতর খাটিয়ে মানুষ করবো আবার বিসর্জনও দিতে হবে আমাকেই! অর্থাৎ স্বামীর সাথে স্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে। কেন বেয়াই সাহেব, তুমি কেন তোমার ছেলেকে আমার মেয়ের সাথে সংসার করার জন্য তার বাপের বাড়িতে পাঠাতে পারবে না? তোমাদের পুরুষত্বে আঘাত লাগবে, তাই? একজন কন্যার পিতার কি ইচ্ছে করে না তার সন্তানকে পাশে রাখবার?
নিরাপত্তা প্রশ্নে আমাদের (কন্যা সন্তানের পিতা) সর্বদা ঘুম হারাম। দেশে কিংবা বিদেশে, রাস্তায়, রেস্তোঁরায়, স্কুলে, প্রাইভেটে, গণপরিবহনে কিংবা জনারণ্যে কোথাও কি আমাদের কন্যারা নিরাপদ? কন্যার বয়েস এখন মুখ্য নয়, শিশু থেকে বার্ধক্য, কোন কালেই তারা নিরাপদ নয়। বাবার ঘরেও নয়, স্বামীর ঘরেও নয়। কারন বিয়ের পরেও পিতার দুশ্চিন্তার হয় না অবসান। আমার কন্যার কোন ভুল হোক বা অপছন্দনীয় কিছু হলেও আমাকেই টেনে আনা হবে জানি।
আমাদের সাথে কয়েকজন বন্ধু ছিলো ইউনিভার্সিটিতে, তারা যে বিবাহিত সেটা শুরুতেই জানা ছিলো না। তাদের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। তাই অল্প বয়েসেই তাদের বিবাহ দেয়া হয় অবস্থা সম্পন্ন পিতার অপ্রাপ্ত বয়স্ক কন্যাদের সাথে। তাদের পড়ালেখার যাবতীয় ব্যয় শ্বশুর মহাশয়েরাই যুগিয়েছেন। কন্যাদের পিতার এটা ছিলো বিনিয়োগ বা উপহার কিংবা যৌতুক যে নামেই আপনি ডাকুন। বাংলাদেশের বিশেষ একটি অঞ্চলে এই প্রথা দেখেছি আমি। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে আসা একজন ছাত্রকেও জানতাম, যার একটি পুত্র সন্তান ছিলো, তার শ্বশুরের পয়সায় এই দেশে এসেছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। কোন এক আড্ডায় সে বলছিলো, তার স্ত্রী যথেষ্ঠ স্মার্ট নয় (বোঝাতে চেয়েছিলো তার সাথে ঠিক মানায় না, কারন সে একজন প্রকৌশলী হতে যাচ্ছে আর স্ত্রী একটা গ্রামের মেয়ে)। এই ছেলেটির কাছে কি তার স্ত্রী ও সন্তান নিরাপদ? তার শ্বশুরের বিনিয়োগ জলে গিয়েছে বোধ করি।
উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যেও এই দৈন্যতা বিদ্যমান। একজন ভালো ছাত্র পড়ালেখা করতে পারছিলো না দেখে একজন শিক্ষক তাকে লালন পালন করলেন। নিজের সুন্দরী ও সুশিক্ষিত মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন। আরো উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে দেশের বাইরে পাঠালেন নিজের টাকায়। ফিরে এসে তার মেয়ে জামাইয়ের পা আর মাটিতে পড়ে না। সেই কন্যাকে পাগল প্রায় দেখেছি আমি। কম বেশী এটাই বাস্তব চিত্র।
এখনো কন্যা সন্তান জন্ম হলে অপচয় কিংবা জরিমানা অথবা মন্দ ভাগ্য হিসেবেই দেখা হয়। অন্যদিকে পুত্র সন্তান লাভে উপার্জন কিংবা পুত্রবধূর পিতার মাধ্যমে বাড়তি কিছু অর্থের আগমন বুঝে স্বস্থির ঢেকুর তোলেন কেউ কেউ। আধুনিকতা কিংবা প্রগতিশীলতা যাই বলি না কেন, মানসিকতার আদিম প্যাটার্নে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
একসময় মেয়েদের রূপ বিবেচনা করা হতো বিয়ের জন্য। পাত্রীর বংশ পরিচয়ও কিছুকাল বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে। এখন পাত্রীর রূপ, বিদ্যা, গুণ, পিতার ঐশ্বর্য সেই সাথে চাকুরী হলে ভালো হয় ইত্যাদি, ইত্যাদি... অর্থাৎ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়ছেই। একজন কন্যা সন্তানের পিতা কি তার সন্তানকে এটিএম বুথ ভাবেন কখনো? একজন কন্যাও কি চাইলেই ফিরে তাকাতে পারেন পিতার দিকে? এই সমাজ কি সেই কন্যাকে মেনে নেবে?
পুত্র যদি একজন পিতা কিংবা মায়ের জন্য বার্ধক্যের অবলম্বন হয়ে থাকেন, তাহলে কন্যার পিতা মাতার ঠিকানা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধাশ্রম! বার্ধক্যে আশ্রমের ব্যয় নির্বাহে এখনই একটি তহবিল গঠন করা জরুরী হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য। এটা নিয়ে একটি বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় আসছে। হয়তো এই স্কিম যে কোন একটু চতুর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালুও করতে পারে। মন্দ হয় না।
আমার দুই কন্যা, স্ত্রী অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। আমাদের পরিবারে পুরুষদের (দাদা/বাবাকে দেখে অন্তত তাই মনে হয়) বেঁচে থাকার রেকর্ড ৫৫ বছর খুব বেশি হলে। মাঝে মাঝে বিষণ্ণতা ভর করে, স্ত্রীর কথা মনে হলে। মৃত্যুমুখেও শান্তি নেই। তবে একটা ইচ্ছে আমার প্রবল এখনো। এমন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়েই দেবো না, যে আমার সাথে থাকবে না। তবে মেয়েদের বিয়ে দেবার সুযোগ পাবো কি না সেটা এখনো অনিশ্চিত।
মানব জীবন এতো জটিল কেন?
লেখক: উন্নয়নকর্মী