আইএস এবং আমাদের সমাজ; সর্বত্র পুরুষতান্ত্রিকতার জয়!
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৬, ২৩:৩৬
চকচকে চেহারার লোভে পরে কী নিদারুণ ভাবে নিব্রাসদের পক্ষ হয়ে কথা বলছে কিছু রমণী! “কি ইনোসেন্ট, কী সুইট, আহারে” বলা নারীরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না যখন শরীরে ৩০ থেকে ৪০ বার কোপ লাগে কেমন লাগে! সন্তান পেটে নিয়ে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও রক্ষা না পেলে কেমন লাগে! শুধু যে সুন্দর চেহারার আকর্ষণে জঙ্গিদের পক্ষে আহা উহু করছে তাও নয়। অনেক মহিলা আছে যারা শফি হুজুরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি মনে করে। এই সম্মান আর ভক্তি দেখানোর সাথে সাথে তারা শফি হুজুরের বক্তব্যকে “নারী তেঁতুলের মত” প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করে। কী চমৎকার! নারী তুমি নিজ থেকেই স্বীকার করো যে তোমাকে দেখলে পুরুষদের জিভে লালা আসে। পুরুষ তোমাকে যা শেখাচ্ছে তাই গিলছো কোনোরকম নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছাড়া। নিজেকে খাদ্য ভাবতে এতটুকু লাজ হয় না।
গুলশানের হামলায় নিহতদের মধ্যে নারীদের প্রতি পাশবিকতা দেখিয়েছিল জঙ্গিরা, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলে। নারীদের প্রতিই কেন এত আক্রোশ, এত ক্ষোভ, এত ঘৃণা? মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও কেন নারী শরীরে এত অত্যাচার, এত জখম, এত নির্মমতা? জঙ্গিদের মগজে ছিল যে’ই সুরা পারবে না, পর্দা করবে না তাদের মেরে ফেলবে। তবে ছেলেদের যেমন মেরেছে নারীদেরও তেমন মারতে পারত। সেটি করে নি কারণ তাদের মগজে এও ছিল নারী খারাপ, হীন, নারীদের জন্য ছেলেরা বিপদ গামী হয়। ধরে নিলাম এদের মগজে এমন কথা তাদের গুরুরা ঢুকিয়েছে যাদের কাছ থেকে তারা জঙ্গি হওয়ার ট্রেনিং নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজেও কি এমন কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় না? অহরহ হয়, প্রতিনিয়ত হয়। এখানে আমরা শিক্ষা দেই নারী ঋতুবতী সময়ে নাপাক থাকে। নারীরা ধর্ষিত হয়, শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়, ইভ টিজিং এর শিকার হয়। তবে কানাকানি করি নিশ্চয়ই মেয়ের পোশাক ঠিক ছিল না, অথবা এক হাতে তো তালি বাজে না, মেয়েও নিশ্চয়ই ছেলেকে উস্কে দিয়েছিল! ধর্ষণের মত চরম অমানবিক অত্যাচারেও মেয়ের দোষ খুঁজি। কোনো না কোনোভাবে এটিকে প্রমাণ করতে চাই যে মেয়ের নিশ্চয়ই কোনও ভুল ছিল। কোনো না কোনোভাবে প্রমাণ করতে চাই ধর্ষক বাধ্য হয়েছিল!
আমরা শিক্ষা দেই নারী দুর্বল পুরুষের তুলনায়, তাকে একবার কেউ ধর্ষণ করলে তার সম্মান থাকে না, সে হয়ে যায় নষ্ট, সমাজের চোখে পতিত! মেয়েদের গড়ে তোলা হয় এইভাবে যেন পুরুষের জন্য তৈরি, তাকে থাকতে হবে পুরুষের অধীনে, হয় বাবা নয় স্বামী। যার বিয়ে হয় না বা করে না সে হয়ে যায় “খারাপ মেয়ে”। অর্থাৎ পুরুষের অধীনে না গেলে সে ভাল না, পুরুষের অধীনে থাকলেই সে ভাল-সতী-লক্ষ্মী।
শুধু অধীনে থাকলেই হবে না তাকে থাকতে হবে পর্দার আড়ালে। এই যে নারীদের পর্দা প্রথার চল, সেটির কারণ কী? কারণ একটাই নারীর শরীরের কোনও উঁচু নিচু বাক দেখে যেন পুরুষ কামনা বাসনায় লালায়িত না হয়। মানে নারীকেই ঢাকতে হবে পুরুষের লোভ সংবরণ করার জন্য। যে ঢাকবে না, পর্দা করবে না, বোরকা পরবে না, ওড়না পরবে না; সে মেয়ে খারাপ, সে মেয়ে ছেলেদের মাথা নষ্ট করে, ছেলেরা খারাপ কাজ করে এসব মেয়েদের জন্য। কী চমৎকার অজুহাত সমাজের! যে সমাজ শেখায় ছেলেদের খারাপ হওয়ার জন্য নারীরা দায়ী, নারীদের অপমানের জন্য নারীরাই দায়ী, ছেলেরা যেন তাদের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখে সেজন্য ছেলেরা নয় বরং মেয়েদের পর্দার ভেতরে থাকতে হবে, মেয়েদের কাজই হচ্ছে স্বামী পরিবারের সেবা করা, স্বামীকে শারীরিক ভাবে সুখী করা; সে সমাজের ছেলেরা মেয়েদের নিজেদের চেয়ে ছোট মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। পরিবার সমাজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, “এই হচ্ছে মেয়ে, যার বুক ঢেকে চলতে হয় বাড়তি কাপড়ে, এই হচ্ছে ছেলে যে চাইলেই শার্টের বোতাম খুলে ফেলতে পারে একটু গরম লাগলেই”। মননে আমরা গেঁথে দিচ্ছি নারী পুরুষের অবস্থান, সেখানে খুব সহজে কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে টার্গেট করে তাদের মগজ ধোলাই করা খুব কঠিন বিষয় নয়। তার প্রমাণ আমরা দেখলাম। সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্ররাই আজ জঙ্গি হয়ে সর্বোচ্চ নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে মেয়েদের।
আইএস’রা নারীদের যৌনকর্মে ব্যবহার করে, তাদের হাটে বাজারে বিক্রি করে, তাদের অমানুষিক নির্যাতনের ভিডিও অডিও আপলোড করে। আমরা হাহাকার করে উঠি এসব শুনে-দেখে। তাদের ঘৃণা করি মন থেকে। একটু মাথা ঘুরে তাকালে দেখা যায়, যৌতুকের দায়ে পুড়িয়ে মারছে গৃহবধূকে, এসিড ঢালছে চেহারায়, ধর্ষণের পর হত্যা, প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানি, একান্ত মুহূর্তের ছবি ভিডিও ছেড়ে নাজেহাল করা; আমাদের সমাজের নিত্য ঘটনা। যারা করে তারা কেউ কিন্তু আইএস না। তারা আমাদেরই মত মানুষ। খুব বেশি কি পার্থক্য আই এস’এর অত্যাচার আর আমাদের সমাজের অত্যাচারের সাথে? হয়ত সামান্য। জঙ্গি আস্তানায় তারা স্বেচ্ছাচারিতার সর্বোচ্চ প্রমাণ দিতে পারে, সমাজের অত্যাচারী পুরুষরা সেটা পারে না, কিন্তু মনোবাসনা একই। পুরুষতান্ত্রিক চেতনা আমাদের আশেপাশে কি নিবিড় ভাবে শেকড় গেড়েছে! আই এস হতে শুরু করে পাশের বাসার নিরীহ দেখতে লাগা পুরুষটিও একই মানসিকতায় বিকশিত।
পৃথিবী এগুচ্ছে, সাথে সাথে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও এগুচ্ছে। ঘরের অন্ধকার রুম হতে শুরু করে জঙ্গিবাদের সিরিয়াতে সব জায়গায় নারী বিদ্বেষ, নারী নির্যাতন। জঙ্গিবাদ হয়ত আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু পরিবারের আপন মানুষ আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে। তাদের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব, মানসিকতা পরিবর্তন করা সম্ভব। শুরু করুন সন্তানদের দিয়ে, তাদের শিক্ষা দিন নারীকে আগে মানুষ ভাবতে। কী নির্মম বলে চিৎকার করে উঠি আই এস’দের নির্যাতনের কাহিনী পড়ে, আশেপাশে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও চিৎকার করে উঠুন।
লেখক: ব্লগার