সুবিধাবাদী পুরুষের বেগম রোকেয়া ব্যবচ্ছেদ ও নারীবাদ
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:৩৬
“যাহা যাহা পুরুষ পারিবে তাহা তাহাই নারী পারিবে” উনিশ শতকে নারী যখন আক্ষরিক অর্থেই অবরোধবাসিনী- সেই সামন্ততান্ত্রিক, গোঁড়া ধর্মীয় আবহে এই সৎ উচ্চারন করেছিলেন বেগম রোকেয়া। পুরুষতন্ত্র বেগম রোকেয়াকে খণ্ডিতভাবে পাঠ করে নিজেদের পছন্দমতো একটা চেহারায় হাজির করতে চেয়েছে। আজকের নারীবাদকে সমালোচনা করতে গিয়ে বিপরীতে সুচতুরভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে বেগম রোকেয়াকে। তাঁকে “ভালো মুসলমান নারী” “শালীন” “স্বামীর দেওয়া স্বাধীনতা দিয়ে নিজেকে ডেভলপ করা” ইত্যাদি ইত্যাদি মোড়কে আবৃত করে বাংলার সমাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
যারা বেগম রোকেয়াকে শালীন মুসলিম নারী হিসেবে দেখে সুখ পেয়েছে তারা এড়িয়ে গেছে “আমাদিগকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ‘ঈশ্বরের আদেশপত্র’ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।...এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ-রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে- কথা শুনিতে পাও, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে।” -রোকেয়ার এই লেখা। কোথাও কোথাও ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রকে একসাথে আক্রমন করেছেন তিনি। যেসব শব্দ নিয়ে আমরা এখন নাড়াচাড়া করি, আলোচনা করি বেগম রোকেয়া সেই আমলেই সেসব নিয়ে সুতীব্রভাবে শ্লেষ করেছেন, ‘দাসী’ শব্দে অনেক শ্রীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ কি? দানকর্তাকে 'দাতা' বলিলে যেমন গ্রহণ কর্তাকে ‘গ্রহীতা’ বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে ‘স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর’ বলিলে অপরকে ‘দাসী’ না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন?”
তো বেগম রোকেয়ার দর্শন থেকে সুবিধামতো বিভিন্ন অংশ বাদ দিয়ে পুরুষেরা তাকে মহিয়সী নারী বানিয়ে দিয়েছে। রক্ত মাংসের বেগম রোকেয়ার বৈধব্যের যন্ত্রনা নিয়ে লেখা অত সামনে আসে না যতটা আসে স্বামী এবং ভাই এর দয়ায় ইংরেজি শিক্ষা পাওয়ার বিষয়টি। পর্দাপ্রথা নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়া নারীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীরের গল্প অত করা হয় না যতটা অংকিত হয় তাঁর ফুলস্লিভ ব্লাউজ। এখনও হিজাব আর পর্দার আধিক্য নিয়ে কথা তুললে বেগম রোকেয়ার শালীনতার ছবি সামনে তুলে ধরা হয়। বেগম রোকেয়া নিয়ে সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা হলে তাই সহীহ নায়িকা শাবানা রেডি হয়ে যান বা পরিচালক-প্রযোজকও তার কথা ভাবেন।
শুধু তারা কেন, ছোটবেলা থেকে নারী স্বাধীনতা বলতে বেগম রোকেয়ার নারী শিক্ষার কথা শুনে আসছি। কারণ এইটা নিরাপদ। গত শতাব্দীতে বেগম রোকেয়া লড়াইটা জারি রেখে গেছেন অন্তত শিক্ষার আলোটা দিতে। মুঠো মুঠো আলো আনতে চেয়েছেন তিনি নারীর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করেই। তো আমাদের ক্রমশ চালাক সুবিধাবাদী পুরুষ শিক্ষিত দাসী পেতেই নারীশিক্ষার পক্ষে কাজ করেছেন। এবং সেই শিক্ষা নিয়ে কোন নারী সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত হলে, বঞ্চনা আর ডিসক্রিমেনেশনের বিরুদ্ধে কথা বললে নিষ্ঠার সাথে তার টুঁটি চেপে ধরেছেন। কাল বেগম রোকেয়া দিবস। ভাবতেছি আর কিছু নয়, সবার আগে তাঁর লেখাগুলোই ভালোভাবে পড়বো আর কেন তারে পুরুষেরা এতো মহিয়ষী হিসেবে হাজির করলো, কেন তার বিষটুকুর মন্থন থেকে বাঁচতে পেরেছেন পুরুষেরা- সেটা বুঝার চেষ্টা করবো। বেগম রোকেয়ার মতো আত্মশক্তিতে বল পাওয়া এক নারী যিনি বলেছিলেন, “আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি” সেই নারীরে পুরুষেরা হঠাৎ দলে দলে কি জন্য মহিয়সী নারী বানিয়ে দিলেন এবং তাঁকে মেয়েদের অনুসরণ করা উচিত বলে ঘোষণা করছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক