বাবা মায়েরাও একটু মানুষ হোন

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১৭

সম্প্রতি অন্তত দুটি ঘটনায় দু'জন নববিবাহিতা নারী আত্মহত্যা করেছেন কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো চাকরি করার জন্য। রিলেটেড অন্যান্য কারণও থাকতে পারে, কেস শেষ না হওয়া অবধি কিছুই বলা যায় না। তবে, আমি শুধু মা হিসেবে দু'চারটে কনসার্ন রেখে যাই। আমরা সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করছি তো? কোথাও কোন বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? আরও মেয়েকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, এমন ভবিষ্যৎ তৈরি করে যাচ্ছি না তো?

এক, ছেলে সন্তান আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে 'আপব্রিংগিং' এ তফাত করাটা একটা সুপরিচিত নিয়ম আমাদের সমাজে। যে বাড়ি মেয়েকে স্বাবলম্বী বানায়, তারাও দুধের গ্লাস আর মাছের বড় টুকরো ছেলেকে দেয়। কথায় কথায়, মেয়ে যখন বাড়ির কাজটাও সাথে শিখুক, বলে। "আমার মেয়ে রাঁধতেও পারে" বলে প্রতিবেশীর কাছে গর্ব করে, ছেলের জন্য কিন্তু করে না। এই যে তফাতটা, অতি সূক্ষ্ম তফাতটা, এটাই কিন্তু একটা মেয়ের "ছেলে আর মেয়ে আলাদা" এই মানসিকতা গড়ে দেয়। বিয়ের পরেও তারই প্রতিফলন ঘটে। স্বামী খানিক হুকুম করতে পারে, আয়েশ করতে পারে, অন্যায় জুলুমও করতে পারে। কারণ সে পুরুষমানুষ। এই মানসিকতা তো আমরাই তৈরী করে পাঠাই মেয়ের মধ্যে।

দুই, স্বাবলম্বী হওয়া। অর্থনৈতিক এবং মানসিক, দুভাবেই। বেঁচে থাকতে গেলে টাকা লাগে এবং সেটা রোজগার করতে হয়, এটা একটা কঠিন সত্য। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের উচিত একটা বয়সের পর নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া। চাকরি করার জন্য কেউ চাপ দিক বা না দিক। শ্বশুরবাড়ি অবধি যাওয়ার কী দরকার, মেয়েকে এই সহজ সত্যি কথাটা কেন শেখাবো না? যে মেয়ে চাকরি করে না, ঘরে শ্রম দেয়, তাকে কোনরকম ছোট না করেও বলা যায়, কেন সে একা শুধু ঘরে শ্রম দেবে এবং বাইরে যাবে না? কেন? ঘর এবং বাইরে, বিয়েতে দু'জায়গাতেই দুজনের সমান দায়িত্ব, যদি না কোন শারীরিক অসুস্থতা থাকে। আমি নিজেই যদি নিজের আর্থিক দায়িত্ব নিতে না চাই, অন্য কেউ কেন নিতে বাধ্য থাকবে? প্রচুর মেয়ে সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেয়, এই বলে যে সন্তান কে দেখবে? হাজার হাজার লাখ লাখ নারী সন্তানকে ডে কেয়ারে রেখে চাকরি করেন। তাদের সন্তানরা সবাই অমানুষ হচ্ছে কি? স্বাবলম্বী হওয়াটা বেসিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। ও লাজুক, এ কথা কম বলে, এসব কোন যুক্তি না। যে লাজুক তাকে কেউ ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করতে বলে নি। পৃথিবীতে আরও হাজারটা কাজ আছে করার।

তিন, যদিও দ্বিতীয়টা করলে এইটা করতে লাগবে বলে আমার মনে হয় না, তবুও বাবা মা দয়া করে বিয়ের আগে মেয়েকে একটু বলবেন কি যে বাবার বাড়িতেও তার একটু ক'দিনের জন্য জায়গা হবে, খুব অসুবিধা হলে, যতই তার বিয়ে হয়ে যাক না কেন? বলবেন কি যে পাশের বাড়ির কাকিমার তির্যক দৃষ্টির চেয়ে মেয়ে তার কাছে দামী? মেয়ে যাবে কোথায়? এই প্রশ্ন শুনে শুনে কানে ব্যথা হয়ে গেছে। আর শুনতে ইচ্ছা করে না। অত্যাচারিত মেয়েকে দু'দিন আশ্রয় দিলে যাদের মান যায়, তারা মেয়ে সন্তান জন্মালে মেরে ফেলেন না কেন আমি বুঝি না! বাঁচিয়ে রেখে কী হবে যদি এই পরিণতির দিকেই ঠেলে দিতে হয়?

বাবা মায়েরাও একটু মানুষ হোন দয়া করে। খালি খুনীকে দোষ দিয়ে লাভ কী, যদি আপনি একজন ভালনারেবেল, আত্মসম্মানহীন, নিজেকে রক্ষা করতে অসমর্থ, ভীতু পোটেনশিয়াল ভিক্টিম তৈরী করে তাকে খুনীর কাছে পাঠান? আপনি তো জেনেশুনেই মেয়েকে মরতে পাঠিয়েছেন, অভিযোগের চারটে আঙুল তো আসলে আপনারই দিকে।

লেখক: প্রকৌশলী

0Shares
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত