ছেলে সন্তানের মায়েরাও একটু ভাবুন
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ২১:০১
ছেলেটার বয়স ৩০ পেরিয়ে গিয়েছে। এখনো বাহির থেকে এসে জুতা জোড়া কোথায় রাখতে হয় জানে না। হাতঘড়িটা খুলে ডাইনিং টেবিলেই রাখে। স্যান্ডো গেঞ্জিটা বইয়ের টেবিলে, আন্ডাওয়ার সোজা খাটের নিচে। জিন্সের প্যান্ট দিয়ে মাঝে মাঝে পা মুছা সেরে নেয়, শার্ট দিয়ে বালিশ উঁচু করে নিয়েছে কদিন হলো। টুথব্রাশ তো ওয়াশরুমেই থাকে। শ্যাম্পুর পলিপ্যাকগুলো কমোডেই ভাসে।
আহা এত ফিরিস্তি দিও না তো। বিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেয়েটার বয়স পনেরো ষোলো হয়ে গেলো, এখনো কাম কাজ শিখলো না! সকালের নাস্তাটা তো বানাতে পারিস, কলেজে যাওয়ার আগে কাপড়গুলো ধুয়ে দিয়ে যাস। বিকালবেলা একটু চা বানা তো মা! রাতের মশারিটা টানিয়ে দিয়ে যা।
অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায় বয়স আঠারো পেরোতেই। বরের দেখভাল, শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন, ননদ দেবরের আবদার সবই মিটাতে হয়। তবুও মাঝে মাঝেই শুনতে হয়, বউটা তেমন কাজ কর্মের নয়। সাজগোজ ছাড়া আর কিচ্ছু শিখে আসেনি।
কেন এই ব্যবধান, দুজনেই কি নয় মা বাবার সন্তান?
দুটোকেই কেন সংসারের কাজ ভাগ করে দেওয়া হবে না? কেন মা বাবা দুজনেই সন্তানের ডায়াপার খুলে দিবেন না? বাবুর ছোট কাপড়গুলো ধুয়ে দিতে বাবাও কেন পারবে না? বাজার থেকে মাছ কিনে এনে কেটে ধুয়ে নেওয়া কি অপারেশন করার চেয়েও বেশি কিছু? মশারির কোনা ধরে ঝুলিয়ে দেওয়াটা কি জ্যামিতির মাপজোকের চেয়েও কঠিন?
ছেলেদের নুন্যতম বিয়ের বয়স ধরা হয়েছে ২১ বছর, মেয়েদের ১৮ বছর। ক্ষেত্র বিশেষে ১৬ বছর, আবার অনুমোদন সাপেক্ষে তা ১৩, ১৪ তে গিয়েও ঠেকছে। (বয়স ১৬,১৭ না হলে তো অভিবাবক হয়েও বিয়ে দিতে পারছেন না, বলা উচিত গলার কাঁটা সরাতে পারছেন না, সেখানে টাকা খরচ করে জালিয়াতি করে নকল জন্ম নিবন্ধন করিয়ে হলেও মেয়েকে বয়স্ক করে তোলা এখন ডাল ভাত)। যেখানে একটা ত্রিশোর্ধ সমর্থ, জোয়ান ছেলেকেও বলা হচ্ছে বিয়ে দিলে ঠিক হবে। অর্থাৎ বউ এসে তাকে শিখিয়ে নিবে। সেখানে একটা তেরো চৌদ্দ বছরের কিশোরী কিংবা ষোড়শীকে চিন্তা করা হচ্ছে পুরো সংসারের ফাই ফরমাশ, দাবী পূরণের যন্ত্র হিসাবে। কেননা যন্ত্রও কিছুটা সময় বিরাম পায়, ফুয়েল নেবার বা অকেজো হওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার, কিন্তু একজন মেয়ে মানুষকে চব্বিশ ঘন্টা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।
দিনের কাজ শেষে পরিবারের পুরুষ সদস্য যখন নিজেকে পরের দিনের কর্ম উপযোগী করে তুলছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, আরাম করে টেলিভিশন দেখছেন বা পাড়ার রকে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন, তখনও মেয়েটি রাতের খাবার বানাতে ব্যস্ত। সকলের খাওয়া শেষে তলানিতে পড়ে থাকা খাবার খেয়ে এঁটো পরিস্কার করে, সব দরজায় শিকল আছে কিনা পরখ করে যখন বিছানায় যায়, তখন ওখানে তার ডিউটি থাকে। (সংগত কারণেই বিস্তারিত বলছি না নিজ নিজ বুদ্ধি খরচ করে বুঝে নিবেন আশা করছি)। অতঃপর রাতভোরে যখন সকলেই সুখস্বপ্নে বিভোর, তখন মেয়েটি কান তুলে শুনতে পায় মোয়াজ্জিন হাঁক ছেড়ে ডাক দিচ্ছেন আল্লাহু আকবর। আরেকটি দিনের সকাল শুরু। এই তো আমাদের সমাজের আটপৌরে মেয়েদের রোজকার জীবন। তদুপরি কোন মেয়ে যদি কর্মজীবী হয়, তাহলে তো তাকে পায়ে খুর লাগিয়ে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। যেন চাকরী করাটাই প্রধান অপরাধ। কেন এমন হবে? মেয়েদের কি মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই?
মেয়েটাকে যোগ্য বউ করে তোলার পাশাপাশি যদি ছেলেটাকেও যোগ্য স্বামী হওয়ার তালিম দেওয়া হতো, জীবনের ছোট ছোট কাজের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল না হতে শিক্ষা দিয়ে তোলা হয়, তাহলে তো জীবন যুদ্ধে এদের প্রতি পদক্ষেপে কাজের বুয়া নামক সংসার সেনাপতির হাতে জিম্মি হয়ে থাকতে হতো না। সংসার যদি দুজনের হয়, কাজের দায়িত্বও দুজনে ভাগ করে নিতে অসুবিধা কোথায়?
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী