এক পুরুষবিদ্বেষীর জবানবন্দী (শেষ পর্ব)
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০১৭, ২২:৪৯
আরো হাজারো উদাহরণ টেনে এনে আপনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারি আমি। আপনি ধর্ষণ করেন না, যৌনহেনস্তা করেন না, এসিড আক্রমন করেন না, বউকে মারেন না, কিছুই করেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় আপনি মহান। যতদিন অব্দি নিজের ভেতরের সব পুরুষতান্ত্রিক গুণাবলী থেকে মুক্ত হয়ে, পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারছেন, ততদিন আমি আপনাকে মহান ভাবতে পারবো না। ততদিন অব্দি আমি বলেই যাবো সব পুরুষ সমান তার ভেতরের পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বার জন্য, পুরুষ অহংবোধের জন্য।
এই যে নারীমুক্তি নিয়ে বড় বড় ভাষণ হয়, "নারীকে জাগতে হবে", "অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে" ইত্যাদি প্রভৃতি, আসলে নারীমুক্তি তখনই সম্ভব, যখন একজন নারী এগিয়ে যাওয়ার সময় তার পরিবার, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের সমর্থন পাবে। কারণ রোজ রোজ যদি আমার অধিকার নিয়ে ঘরে বাইরে পুরুষদের সাথে ঝগড়া করতে হয়, (কারণ অধিকার ছিনিয়ে আনতে গেলে ঝগড়া হবেই) তাহলে একটা সময় আপনারাই তকমা দেবেন "কি মুখরা", 'কি ঝগড়ুটে', 'কি পুরুষবিদ্বেষী' এইসব বিশেষণে। আর আমিও একটা সময় ক্লান্ত হয়ে, উপরন্তু যদি মানসিকভাবে দুর্বল হই, এইসব তকমাগুলো থেকে বাঁচতে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাবো।
একজন নারীকে, সে স্ত্রী হোক, বোন হোক, মেয়ে হোক, তাকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে গেলে, মন থেকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে লাগে, তাকে মানুষ ভাবার দুঃসাহস থাকতে লাগে। পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র যাই বলি না কেন, সেটা আপনাদের শ্রেষ্ঠ বানিয়েছে, মাথায় তুলে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু নারীর চলার পথে তাকে সর্ব অবস্থায় সমর্থন করার মতো মানসিক শক্তি দেয়নি।
এবার আসি আমার কথায়। আমি যখন বলি বা লিখি, সংখ্যালঘু/দলিত/আদিবাসী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ভারতজোড়া মোদী ওয়েভের বিরুদ্ধে, তখন কিন্তু মুক্তমনা, আধুনিক, প্রগতিশীল, উদারমনা এই আপনারা কখনোই বলেন না, এভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করবেন না, সংখ্যালঘু/দলিত/আদিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোনো আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, এভাবে একশ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর দরকার নেই, আপনার বাবাও পুরুষ, আসুন সব মানুষের কথা বলি, মানবতার কথা বলি, সব মানুষ এক নয়! বরং তখন আপনাদের প্রশংসা, সহযোগীতা, পাশে থাকায় আমি ভেসে যাই।
কিন্তু যখন আমি বলি, পুরুষেরা নারীকে ধর্ষণ করে, পুরুষেরা নারীর মুখে এসিড ছুঁড়ে মারে, পুরুষেরা যৌনহেনস্তা করে, পুরুষেরা ইভটিজিং করে, পুরুষের জন্য নারী অনিরাপদ, পুরুষেরা ধর্ষণের ভিডিও চড়া দামে বিক্রি করে, ঠিক তখনই আপনারা আমায় 'খ' বর্গীয়, 'ম' বর্গীয় গালি দিয়ে বলেন, আপনি তো বড় ইতর, বড় বদ, আপনার বাবা কি পুরুষ নন?, এভাবে নারী-পুরুষ আলাদা করবেন না, এভাবে পুরুষবিদ্বেষ ছড়াবেন না, এভাবে পুরুষকে গালি দেবেন না, এভাবে নারীর জন্য আলাদা কোনো আন্দোলনের দরকার নেই, তার চেয়ে মানবতাবাদী হোন, সব পুরুষ এক নয়।
স্কুলে সমাজবিজ্ঞানে আমি, আপনি সবাই পড়ে এসেছি, মুখস্ত করে পরীক্ষায় খাতায় বমি করে এসেছি, 'ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক'। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর মুখে, পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষ শব্দগুলো শুনলেই আপনারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেন। র্যাডিকাল নারীবাদী, অতি নারীবাদ, এইসব তকমা দেন। ভাবেন এই বুঝি আপনাদের সময়ের সাথে উদার, মহান, সেক্যুলার সাজা সিংহাসন ধরে কেউ টান মেরে দিলো!
ভয়ংকর নারীবিদ্বেষী সমাজব্যবস্থায় আপনারা যখন আমাকে পুরোষবিদ্বেষী আখ্যা দেন, আমি হেসে গড়াগড়ি খাই। আমার মধ্যে সেই শিশুটাকে খুঁজে পাই, যে সমবেত প্রশংসাবাক্যের মধ্যে গলা তুলে জিজ্ঞেস করেছিলো, “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট