ঐশীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে এক মায়ের আকুতি
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০১৬, ১১:২০
ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঐশী। হয়তো জল্লাদও প্রস্তুত হয়ে যাবে যথাসময়েই। শুনেছি ফাঁসির দড়িতে ঝোলালে জল্লাদেরও শাস্তি লঘু হয়। কিন্তু হতভাগ্য ঐশীর মৃত্যুদণ্ড হয়তো কোন কারণেই আর লঘু হবেনা। কারণ ঐশীর অপরাধের বিচার কাজ প্রায় শেষের দিকে। ডেথ রেফারেন্সের শুনানির জন্য ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা হয়েছে ৭২০ পৃষ্ঠার পেপার বুক। নিম্ন আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মহামাণ্য হাইকোর্টের শুনানি বর্তমানে অপেক্ষমাণ।
পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে তাঁদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানকে দু'বার মৃত্যুদন্ড দেন মহামাণ্য আদালত। প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকাও জরিমানা করা হয়। প্রধান বিচারপতির অনুমোদন পেলেই এই মামলার শুনানি শুরু হবে। হ্যা,আইন তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে চলছে। হয়তো ঐশীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার। তাই হয়তো অবশেষে ফাঁসির মঞ্চেই ঝুলতেই হবে ঐশীকে।
ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে কোথায় থাকবে তার ছোট ভাই ওহী ? তাকে কি জানানো হবে যে একমাত্র বেঁচে থাকা বড় বোনটিও সে হারাতে যাচ্ছে? ফাঁসির ক্ষণ ঘনিয়ে আসার আগে কি বাবা-মার মুখটি মনে পড়বে ঐশীর ? যে বাবা-মাকে সে নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যা করেছিলো। দড়িতে ঝুলে পরার সময় মেয়েটি কি মা বলে চিৎকার করে উঠবে? ঐশীর শেষ কথাটি কি হবে? সেকি বলবে মা আমাকে তুমি বাঁচাও! আমি ভুল করেছি,আমাকে মাফ করে দাও। আরেকবার জন্ম নিলে তোমাদের দুঃখ দূর করবো আমি।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ, দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঐশীর ফাঁসিতে ঝোলার ক্ষণটির জন্যে অপেক্ষা করছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়ার জন্যে সমগ্র দেশ যেভাবে অপেক্ষা করে,আমরাও কি সেভাবেই অপেক্ষা করবো? যে কোনদিন রাত বারোটা এক মিনিটেই হয়তোবা অধীর আগ্রহ নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় জেলখানার বাইরে গণমাধ্যম এবংসাধারণ মানুষ অপেক্ষা করবে। মুহুর্মুহু লাইভ সংবাদ প্রদানের প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে মিডিয়া কর্মীদের।ঠিক তেমনিভাবেই বাবা মা হত্যার অপরাধে ঐশীর মৃত্যুদণ্ডে অসাধু এবং সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, যাক ন্যায়বিচার হয়েছে। কারণ তাদের যুক্তি কেনো সে মাদকাশক্ত হলো,আর কেনইবা বাবা মাকে হত্যা করলো। আমাদের মতো অনেক সাধারণ দেশবাসীই হয়তো ভাবছেন অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে মেয়েটি। এবার যদি দেশে মাদকাশক্তি চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মহাশক্তিধর মাদক ব্যবসায়ীদের ধরার কৌশল আমরা জানিনা। কারণ তারা অতি বুদ্ধিমান ও কৌশলী। যারা আমাদের হাতে এসে আত্মসমর্পণ করে,আমরা সেই অপরিণত শিশুকেই শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলি।
আমার মতো হয়তো অনেকেই ভাবছেন, ঐশীর ফাঁসি হলে সবচাইতে ক্ষতি হবে বাবা-মা হারা দাদীর কাছে লালিত পালিত একমাত্র ছোট ভাইটির। যে শিশুটি একটি দুর্ঘটনার কারণে বাবা-মা আর একমাত্র বোন হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যাবে। যাদের সহমর্মিতা আছে তাঁরা হয়তো ভাবছেন মাদকাশক্ত একমাত্র বোনের হাতে বাবা-মা খুন হলেও সেই ছোট ভাইটির জীবনের প্রয়োজনেই জেলের ভিতরে হলেও সুস্থভাবে বেঁচে থাকা প্রয়োজন ঐশীর। দু'টি সম্ভাবনাময় জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার এই দায়িত্ব মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের। এ বিষয়টি বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনার দায়ও তাই আমাদেরই। ঐশীকে শুধু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার জীবন কেড়ে নিলেই যার সমাধান হবেনা। আইন প্রতিষ্ঠার জন্যে হয়তো জীবনের বিনিময়ে জীবন যাবে,কিন্তু যাদের জীবন ঐশী নিয়েছে তাঁরা বেঁচে গেলেতো ঐশীর উপর তাঁরা প্রতিশোধ নিতেন না। বরংমহামাণ্য রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের মেয়ের জন্যে প্রাণ ভিক্ষাই চাইতেন।
হতভাগ্য কিশোরী মেয়েটির এই করুণ পরিণতির জন্যে কারো কোন দায় নেই। এখানে দায় নেই দেশের,দায় নেই পিতামাতা এবংআত্মীয় স্বজনের, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, সংসদ সদস্যসের, দায় নেই ইয়াবা ব্যবসায়ী কোন জনপ্রতিনিধির কুপুত্রের। দেশ বিদেশের নারী নেতৃত্ব, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।ঐশীর ব্যাপারে একেবারেই নিরব এসকল সংগঠনগুলো। নীরব আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
অথচ আমরা দেখেছি একাত্তরের রাজাকার আলবদরদের ফাঁসির দন্ড মওকুফ নিয়ে দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো কি তৎপরই না ছিলো। কিন্তু, ঐশীর ফাঁসি নিয়ে বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোতো দূরের কথা,দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এক পা এগুচ্ছে না। আমরা জানিনা এর প্রকৃত কারণগুলো কি। বাংলাদেশের স্বনামধন্য কবি নির্মলেন্দু গুণ ঐশীর জন্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন আরো অনেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই মহামাণ্য রাষ্ট্রপতির কাছে ঐশীর প্রাণভিক্ষা চাচ্ছেন। কিন্তু শক্তভাবে আইনের সহায়তায় অথবা সংগঠিত ভাবে জনমত তৈরীতে কেউ কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
ঘটনার সময় সে প্রাপ্তবয়স্ক ছিলো কি ছিলোনা সে বিষয়টি নিয়েও সাধারণ জনমনে রয়েছে নানা ধরণের বিতর্ক। যদিও আমরা জানতে পেরেছি বিচারক ঐশীর প্রকৃত বয়স প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর সে যে সাবালিকা,এটাও প্রমাণ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার মানসিক সুস্থতার বিষয়টি নিয়ে। তবে সচেতন শিক্ষিত অনেক মানুষেরই অজানা নেই যে দীর্ঘদিন মাদকাসক্তির কারণে সুস্থ, স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্য হ্রাস পায়।দেখা দেয় ডিপ্রেশন,স্কিজোফ্রেনিয়া,বাইপোলার ডিজঅর্ডার সহ অনেক জটিল রোগ। তাই শারীরিক সুস্থতার মতো মানসিক সুস্থ্যতাও একজন মানুষের সার্বিক সুস্থতা বিবেচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।তাছাড়া তার স্পর্শকাতর বয়স বিবেচনায় এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে সমগ্র দেশের মানুষের মধ্যে ঐশীর প্রতি জেগে উঠেছে সহানুভূতি। তার প্রতি রয়েছে সহমর্মিতা, আবেগ আর করুণা, যা কখনই আইনকে অমান্য করে নয়।
তনুর জন্যে রাস্তায় নেমেছে তার বাবা মা। মিতুর জন্যে তার পরিবার। ঐশী হত্যা করেছে তার নিজ পিতামাতাকেই। পিতা-মাতাকে হত্যা করে সে অন্যকথায় নিজেকেই হত্যা করেছে। সে নিজেই দাঁড়িয়েছে নিজের বিপরীত অবস্থানে।গতবছরের ১৫ অক্টোবর এই হতভাগ্যে মেয়েটির মা হয়ে জীবন ভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম ''ঐশীর মায়ের একটি অলৌকিক চিঠি'' শিরোনামে। কারণ ঐশীর বাবা মা কেউ নেই, তাঁরা বেঁচে থাকলে মহামাণ্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারতেন।
আমরা প্রাপ্তবয়স্ক সকল বাবা-মা আশা করছি ঐশীর ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে তাকে কোন লঘু দণ্ড দেয়া হবে। কারণ ঐশী বয়সে ঐশী অনেকটাই অপরিণত। শারীরিক বয়স এবং মানসিক বয়স সকলের ক্ষেত্রে একসাথে পরিপক্ক হয়না। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বখে গিয়ে যে ভুল সে করেছে, যে অপরাধ করেছে,সেটা শুধরে নেয়ার সুযোগ তাকে মহামান্য আদালত দেবেন এই প্রার্থনা আমাদের সকলের। যারা ঐশীর মতো মেয়েদের মাদকের দিকে ঠেলে দিয়েছে,তাদের খুঁজে বের না করে ঐশীকে ফাঁসির দন্ডে ঝোলালে হয়তো বিষয়টির আপাত সমাধান হবে, কিন্তু মাদকের করাল থাবা থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না, তৈরি হবে আর অনেক ঐশী,খুন হবে অনেক বাবা-মা।
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড