ব্লু হোয়েল গেম ও বিজ্ঞানের কেড়ে নেওয়া আবেগ
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:০০
“বিজ্ঞান জীবনে আনিয়াছে বেগ কিন্তু কাড়িয়া নিয়েছে আবেগ’’ যা বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ব্লু হেয়েল নামের মামুলি একটা গেমই তরুণ-তরুণীদের জীবন কেড়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান যদি জীবনে বেগ আনার সাথে সাথে বাড়িয়ে তুলতো মানুষের আবেগ তাহলে নিরীহ প্রাণী নীল তিমির নামে তৈরি করা গেম তো দূরে থাক শক্তিশালী প্রাণী গন্ডারের নামে তৈরি গেমও আমাদের প্রাণ নিতে পারত না। তাই জীবনে বেগ আনার সাথে সাথে বাড়াতে হবে আবেগ। বাড়াতে হবে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানুষ, সমাজ, সংসার, আত্বীয় পরিজন ও প্রকৃতির সাথে সংস্পর্শ।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে মানুষ। বর্তমান প্রজন্ম মেতে আছে তাদের স্মার্টফোন আর ভিডিও গেমে। তবে এ গেমপ্রযুক্তিও আধুনিক হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন নানা রকম সফটওয়্যার ও মেকানিজম আবিষ্কার করেছে। ফলে তরুণরা বেশি আকৃষ্ট হয়েছে, কারণ এই সফটওয়্যার ও মেকানিজমগুলোর যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, তার সঙ্গে তরুণদের জীবনযাপন ও বৈশিষ্ট্যগত মিল থাকায় তরুণরা বেশি আকর্ষিত হয়। কিন্তু ব্যাপার হলো, বেশ কিছুদিন থেকে দেখছি বাংলাদেশ যত বেশি ইন্টারনেটের প্রসার বাড়ছে, তত বেশিই কিন্তু অনলাইনের আকর্ষণটা বাড়ছে। সেই অনলাইনের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই হচ্ছে আজকের এই ব্লু হোয়েল গেমস। এই গেমসের সঙ্গে যারা আসক্ত, তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জায়গায় আমাদের অভিভাবকদের একটি শক্ত ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বা কলেজ পাস না করা পর্যন্ত কোনো ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল যেন তাদের সন্তানদের না দেন। ফোন করার জন্য কম দামি ফোন ব্যবহার করতে পারে। আর আমাদের দেশের শহরে যে অভিভাবকরা থাকেন, তাদের সন্তানদের স্বাধীনতার নামে যেসব সুবিধা দেন, সেগুলো কিন্তু অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়।’ সাধারণত অবসাদগ্রস্ত-বিষন্ন কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করে এই গেম। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে এই গেমের ফাঁদে পড়ে যতজনের প্রাণ ঝরেছে, তার মধ্যেও বেশিরভাগই কিশোর-কিশোরী। সেজন্য দেশের অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে মনোবিদরা বলছেন, যেন তাদের শিশু ও কিশোর-কিশোরী সন্তানদের ওপর নজর রাখা হয়।
বিশেষত যারা ইন্টারনেট-স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আর এরাই গেমের টার্গেট পিপুল। ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ বুদেকিনের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় যে তিনি কেন খেলার নামে টিনেজারদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে তখন তিনি বলেন 'There are people - and there is biological waste.Those who do not represent any value for society. I was cleaning our society of such people.' ২২ বছর বয়সী রাশিয়ান এই যুবকের কাছে গেম খেলে আত্মহত্যাকারী এই টিনেজাররা হচ্ছে 'বায়োলজিক্যাল ওয়াস্ট'! যাদেরকে সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা তিনি নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন। ২০১৩ সালে শুরু করা এই সুইসাইডাল গেমটির ফাঁদে পা দিয়ে সর্বপ্রথম ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল জুলিয়া ওভা এবং ভের্নিয়া ওভা নামের দুই বোন। আত্মহত্যার আগে জুলিয়া ওভা সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি নীল তিমির ছবি আপলোড করে লিখে গিয়েছিল 'The End'!
সাগরের নীল তিমিরা মৃত্যুর আগে তীরে উঠে আসে। অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় যে নীল তিমি সুইসাইড করার জন্যই তীরে আসে। তাই নীল তিমির এই সুইসাইডাল বৈশিষ্ট্যের জন্যই গেমটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ব্লু হোয়েল’। তবে গেমটি ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ, পর্পকর্ন কার্নিভাল সহ আরো বিভিন্ন ছদ্মনামে লুকিয়ে আছে ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েভে। ব্লু হোয়েল অনলাইন ভিত্তিক একটি গেম। অনলাইনে একটি কমিউনিটি তৈরি করে চলে এ প্রতিযোগিতা। এতে সর্বমোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। আর ধাপগুলো খেলার জন্য ঐ কমিউনিটির অ্যাডমিন বা পরিচালক খেলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দিবে। আর প্রতিযোগী সে চ্যালেঞ্জ পূরণ করে তার ছবি আপলোড করবে। শুরুতে মোটামুটি সহজ এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং কাজ দেয়া হয়। যেমন: মধ্যরাতে ভূতের সিনেমা দেখা। খুব সকালে ছাদের কিনারা দিয়ে হাঁটা এবং ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা।তবে ধাপ বাড়ার সাথে সাথে কঠিন ও মারাত্মক সব চ্যালেঞ্জ দেয় পরিচালক। যেগুলো অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এ খেলার সর্বশেষ ধাপ হলো আত্মহত্যা করা। অর্থাৎ গেম শেষ করতে হলে প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হবে। বোঝায় যায় প্রযুক্তি যাদের আবেগ কেড়ে নেয় সেসব কিশোর-কিশোরীই ব্লু হোয়েল গেমের শিকার হয়।
যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনও আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা। এই মরণ ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন। সেগুলো হচ্ছে-প্রথমতো আপনাকেই সচেতন হতে হবে। কেন আপনি অপরের নির্দেশনায় কাজ করবেন। আপনি যাকে কখনও দেখেননি, যার পরিচয় জানেন না, তার কথায় কেন চলবেন বা তার কথামতো কেন কাজ করবেন- সেটি নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।এরকম কোনো লিংক সামনে এলে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। সমাজের তরুণ-তরুণীদের মাছে এই গেমের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। সন্তান, ভাই-বোন বা নিকটজনকে মোবাইলে ও কম্পিউটারে অধিক সময়ে একাকী বসে থাকতে দেখলে সে কী করছে, তার খোঁজ-খবর নিতে হবে। সন্তানকে কখনও একাকী বেশি সময় থাকতে না দেয়া এবং এসব গেমের কুফল সম্পর্কে বলা। সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মানসিকতা সৃষ্টি করা। যাতে তারা আত্মহত্যা করা বা নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করা অনেক বড় পাপ- এটা বুঝতে পারে। সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিনা- সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় তাকে সঙ্গ দেয়া। কৌতূহলি মন নিয়ে এই গেমটি খেলার চেষ্টা না করা। কৌতূহল থেকে এটি নেশাতে পরিণত হয়। আর নেশাই হয়তো ডেকে আনতে পারে আপনার মৃত্যু। এই গেমের নেপথ্যে যারা কাজ করে তারা হতাশা এবং হিরোইজমকে ব্যবহার করে৷ আর ধীরে ধীরে আত্মহননের পথে নিয়ে যায়৷ এটা মোটেই অসম্ভব নয়৷ মানুষের মানসিক অবস্থাকে ব্যবহার করতে পারলে তাকে দিয়ে অনেক কিছুই করানো সম্ভব৷ আপনি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন অনেক তরুণ-তরুণী এই গেম খেলার আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ তারা লিংক চাইছে৷ কেউ লিংক পাওয়ার ঘোষণাও দিচ্ছে৷ তারা মনে করছে তাদের এই গেম কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। তারাও হিরোইজম দেখাতে চাইছে৷ কিন্তু এভাবেই ফাঁদে পড়ে। মনে রাখা দরকার এরকম অনেক গেমই আছে যা আত্মহত্যাসহ নানা ধরণের আত্মবিধ্বংসী কাজে প্ররোচিত করতে পারে৷ তবে প্রথম কাজ হচ্ছে অভিভাবকদের সচেতন থাকা৷ আমার সন্তান অনলাইনে কী করছে তা আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে৷ তাই অভিভাবকদেরও এখন অনলাইন এডুকেটেড হতে হবে৷ অনলাইন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে৷ এই অষ্টম শ্রেণি পডুয়া মেয়েকে যদি ইন্টারনেট কানেকশনসহ অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয় তাহলে এর দায় অভিভাবকদেরই নিতে হবে৷
এই ব্লু হোয়েল গেম যারা আসক্ত তাদের সমাজের সঙ্গে, অভিভাবকের সঙ্গে এবং যারা গেমস ব্যবহার করছে, সেই সন্তানদের সঙ্গে কিন্তু একটি বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে। কাজেই আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয় আছে, তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করবে। আমাদের দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বা এক্সেস কতটুকু হবে, এটা মনে হয় রাষ্ট্রের এখন বেঁধে দেওয়ার সময় হয়েছে। সাধারণ জনগণ কোন কোন অ্যাপস, সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করতে পারবে, তার একটা নীতিমালা করতে হবে। এমন ঘটনার পরে সারা দেশে কিন্তু একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সরকার ও অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। আর সারা দেশে স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের মাধ্যমে এই সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল ও কলেজের তরুণরা বেশি আসক্ত হয়। এই গেমসের মূল বিষয় হলো নিজের প্রতি নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সে কারণে আসক্ত ব্যক্তিকে ফেরানো কঠিন। পরিবার যেন প্রত্যেককে হাসিমাখা একটি পরিবেশ দেয়। তবেই প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেওয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেওয়ার চাবি সরকারের হাতে।
তবে অতি সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই নিজ নিজ বন্ধুদের বিশেষ বার্তা পাঠাচ্ছেন: সাবধান, বাংলাদেশেও পৌঁছে গেছে ব্লু হোয়েল গেম! এ নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে কৌতূহল থেকে জানতে চাইছেন পুরো ব্যাপারটা। কেউ কেউ আতঙ্কও ছড়াচ্ছেন। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সতর্ক অবশ্যই থাকা উচিত। বিশেষ করে উঠতি বয়সীদের দিকে খেয়াল রাখা, ‘দেখি কী হয়’-এর কৌতূহল অনেক সময়ই যাদের নিয়ে যায় ভুল পথে। এ কারণে সচেতনতা বেশি জরুরি। ভুল তথ্য প্রচার বা গুজব রটানো উল্টো এই গেমটির প্রচারণায় বেশি সাহায্য করবে। ফলে, সঠিক তথ্য জেনে রাখাটাই বেশি দরকার। তাহলেই বিজ্ঞান জীবনে আনবে বেগ সাথে বাড়াবে আবেগ।
লেখক: সরকারী কর্মকর্তা
E-mail: [email protected]