পুরুষতন্ত্রের 'বিউটি প্রোডাক্ট' কী দেয় সমাজকে?
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:২০
'অন্যপক্ষ' নামে আমি যে নারী বিষয়ক অনুষ্ঠানটি করি সেটা লাইভ। সরাসরি অতিথির সাথে কথা বলতে পারেন দর্শকরা। তো প্রায়ই শোতে একটা নির্দিষ্ট ধরনের ফোন আসে।
: আচ্ছা আপনারা যে এতো নারী নির্যাতন নারী নির্যাতন করেন পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কিছু বলেন না কেন? কতশত মিথ্যা মামলা নারী নির্যাতন মামলার নামে দেওয়া হয় সেইটা নিয়ে কিছু বলেন না কেন?
আমরা হয়তো একেবারেই তত্ত্বীয় কোন বিষয়ে কথা বলছি তার মধ্যেও একই প্রশ্ন। প্রথম প্রথম আমি খুব বিরক্ত হতাম। এখন ভাবি, আসলে ঠিক কোন জায়গা থেকে পুরুষেরা, একেবারে সাধারণ পুরুষেরা এই অভিযোগগুলো করেন? তারা পুরুষতন্ত্র নামে হারামী সিস্টেমটাকে বুঝুন না বুঝুন নিশ্চয়ই জলজ্যান্ত কিছু অভিজ্ঞতার শিকার হন বলেই অভিযোগগুলো করেন। সম্প্রতি অভিনেত্রী বাঁধন এর সাবেক স্বামীর কিছু বক্তব্য নিয়ে খবর ছেপেছে একটা অনলাইন পত্রিকা। লেখাটা পড়ে প্রশ্ন করা পুরুষদের কথা আমার মনে পড়ে।
পত্রিকার লেখা 'এবারে ধরা খাইছে বাঁধন'-ধরনের। এ ধরনের পত্রিকাগুলো যে উদ্দেশ্যে নিউজ করে থাকে এই নিউজও সেই উদ্দেশ্যের বাইরে নয়। বাঁধনের স্বামী মাশরুর জামান জানিয়েছেন, বাঁধন প্রতিমাসে হাতখরচ হিসেবে একলাখ টাকা চাইতো। ‘বিয়ের পর ও আমাকে নানাভাবে মানসিক অত্যাচার করতে থাকে। তার সব খরচ দেয়ার পরও সে প্রতি মাসে হাত খরচের জন্য ১ লাখ টাকা চাইতো আমার কাছে। আমি দিয়েছিও অনেক দিন। মাসের ২ তারিখের মধ্যেই টাকাটা দিতে হতো। নইলে ঘরে চিৎকার চেঁচামেচি করতো সে।’ পুরো খবরে মাশরুর জামান বাঁধন সম্পর্কে নানান অভিযোগ করেন। খবরের দুর্বলতা হলো, বাঁধনের কোন বক্তব্য এই সংবাদে নেই। বাঁধনকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলে এই সংবাদ আমার বিশ্বাস হতো না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে চেনায় বিষয়গুলো পরিচিত লাগলো।
আমার এক আত্মীয়ের সাথে ২০০৫ সালে বিয়ে হয়েছিল বাঁধনের। এনগেজমেন্টের পর থেকেই এই মেয়ের নানান বায়ানাক্কার গল্প আমরা শুনেছি। বিয়ের প্রত্যেকটা শপিং সে নিজের পছন্দ অনুযায়ী করেছে, কোনটা কোন দোকান থেকে কিনতে হবে রীতিমতো তার লিস্ট নিয়ে ঘুরতো, একটুও এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না। বিয়ের জাস্ট আগের দিন মাথার গয়না নিঁখুত না হওয়ায় হতে চলা শ্বশুর শাশুড়ীকে সারা দিন বসিয়ে রেখেছিল জুয়েলারির দোকানে, গয়না ঠিকঠাক করে তারপর তারা ফিরেছিলেন। তারপর রীতিমতো কয়েকশ লোক খাইয়ে, অর্ধলক্ষ টাকার শাড়ি আর আর কয়েকলক্ষ টাকার গয়না পরে সে বিয়ে করলো। তা করুক। সেসব নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নাই। যারা এতসব গয়নাগাটি দিচ্ছেন তারাই বা কেন দিচ্ছিলেন, এইটা ঠিক স্বাভাবিক জীবনযাপন কি না আমাদের মতো দেশে- সেসব নিয়ে যখন প্রশ্ন তুলি নাই তখন বাঁধনের এই ধরনের প্রাপ্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলি না। কিছুদিন পরে নানান কারণে, বিশেষত তার হাতখরচের চাহিদা না মেটানোয় এবং প্রতিমাসেই গয়না বানানোর আব্দার না রাখায় বাঁধন বিয়ে ভেঙে দেয়।
মাশরুর জামান যা যা বলেছেন আমি কানেক্ট করতে পারি। মাশরুর জামানরা হলেন পুরুষ শিরোমনির শিরোপা। তারা নারীকে একটা বিউটি প্রোডাক্ট মনে করেন। আর্মিতে ছিলেন, ব্যবসা বাণিজ্য করে ভালো কামাইছেন, তারপর একলা জীবনের একাকীত্ব ঘোচাতে সুন্দরী এক মেয়েকে কিনে নিতে চাইলেন। কেনার পর দেখা গেল প্রোডাক্টে গড়বড়। প্রোডাক্ট খালি টাকা চায়। টাকা যোগাতে যোগাতে আমাদের পুরুষশ্রেষ্ঠ হয়রান। মাশরুর জামানরা আমাদের চারপাশে ভুরিভুরি আছেন- পুরুষ নির্যাতনের অভিযোগ এইসব ধরা খাওয়ারা করে থাকেন বেশি। কিন্তু আমার ভাবনায় আসে বাঁধনের জীবনযাপন। কোন ডিগনিফায়েড মানুষের পক্ষে এধরনের জীবন-যাপন করা সম্ভব? আমার আত্মীয়ের সাথে বিয়ে ভাঙার পর সে লাক্স ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতায় গেল। সেখানে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। 'দীর্ঘ পথ' মানে হলো, সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোতে যা যা লাগে আর কি। ডায়েটিং করে শরীর টোন করা, মেকাপ গেটাপ জ্ঞান আর যৎসামান্য অভিনয় প্রতিভা। এইসব সে চর্চা করতে লাগলো। আমাদের ধারনা ছিল, যাক টাকার জন্য বিয়ে ভেঙেছে, এখন শোবিজে গিয়েছে নিজেই তো অনেক টাকা আর্ন করবে। নিজের শপিং বাতিক, রেস্টুরেন্টে পুরো গুষ্ঠি নিয়ে খাওয়ার বাতিকের পয়সা সে নিজেই নিশ্চয়ই বহন করবে। তো লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সে তৃতীয় হলো। দুচারটা নাটকটাটকে অভিনয় করলো এবং মাশরুর জামানকে বিয়ে করলো।
এখন এই মেয়েকে শোবিজ অভিনেত্রী ধরে নিয়ে যদি আলোচনা করি তাহলে আলোচনা একরকম আর যদি সাধারণ মেয়ে ধরি তাহলে আরেকরকম। সব মেয়েই কি বাঁধনের মতো লোভী? সব মেয়ের মধ্যেই কি অন্যের ঘাড়ে বসে খা্ওয়ার প্রবণতা আছে? অসম্ভব পরিশ্রম করে, নিজের পয়সায় সম্মানজনক, মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটা মেয়েদের সকল অর্জন বাঁধনদের মতো মেয়েদের কারণে নষ্ট হবে সেটা কেন মেনে নেবো? এসব নিয়ে কথা না বললে পুরুষ নির্যাতন বিষয়টিও কিন্তু এক অর্থে আড়ালে থেকে যায়। আর যদি শোবিজ অভিনেত্রী ধরি তাহলে কি বার্তা দেয় এইসব অভিনেত্রীরা একটু বলেন তো। যেকোনো শিল্পের সাথে যুক্ত হতে যে মেধা লাগে, ডেডিকেশন লাগে, প্যাশন লাগে তার কোনটাই তো এসব মেয়েদের থাকে না, আমরা এরকম ভুরি ভুরি অভিনেত্রী পাই যারা দুচারটে নাটক সিনেমা করে ব্যবসাদার পাত্র দেখে বিয়ে করে এবং গণমাধ্যমে ন্যাকা ন্যাকা গলায় ঘোষণা দেয়, "বিয়ের পর আর কাজ করবো না" এরা ঠিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে শোবিজে আসে? যেই পুরুষতন্ত্র এই মেয়েগুলাকে পণ্য করে, সেই তন্ত্রের পাতা ফাঁদে স্বইচ্ছায় ধরা দেওয়া এই মেয়েগুলি শিল্প সংস্কৃতিকে কি দেয়? আমাদের দেশে দু'চারজন যে গুণী অভিনয়শিল্পী আছেন তারাও কেন এদের নিয়ে নাচেন?
প্রত্যেকটা মানুষকেই তার স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। নারীদের জন্য এই অর্জনের লড়াই যারপরনাই কঠিনতর। পুরুষদের জন্য বিউটি প্রোডাক্ট এবং ঘরের নান্দনিক আসবাবপত্র হতে আসা নারীরা সমগ্র নারীদের এই লড়াইকে আরও কঠিন আর প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। সবকিছু বাদ দিয়ে নিছক এন্টারটেইনের জগতেও কি মাথা তুলে টানটান দাঁড়ানো নারীর উদাহরণ নেই? বেশি দূর না যাই, পাশের দেশের কঙ্গনা রানাউত বা প্রিয়াংকা চোপড়ারে দেখেন। কোনকিছু পরোয়া করে না তারা। করে না কারণ পুরুষ আধিপত্যকে তারা সাধ্যমতো ভাঙার চেষ্টা করেছে, করে যাচ্ছে নিজের উপার্জন দিয়ে, নিজের শ্রম দিয়ে।
আমাদের দেশের নারীদের অবস্থার মতোই বিনোদন জগতের নারীদের অবস্থাও একইরকম সঙ্গীন। আর এর জন্য পুরুষদের পাশাপাশি বাঁধন টাইপ মেয়েদের ভূমিকাও আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক