নারীবাদ এক রোমাঞ্চকর গতিশীল ভ্রমণ
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০০:৫৯
যে সমাজ ব্যবস্থা নারীর নিজের গর্ভ এবং গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকারের অধিকার পর্যন্ত স্বীকার করেনা, যে ব্যবস্থায় বিয়ে নামক চুক্তির পাতায় “নারী কুমারী কিনা” লেখা থাকে অথচ পুরুষের কৌমার্যের কোন প্রশ্ন থাকেনা, সে সমাজ ব্যবস্থা সংসার সুখী হওয়ার সমস্ত দায় নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক মিথ তৈরী করে, সে সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে থেকে নারীবাদকে বোঝা নারীর জন্য তো সহজ নয়ই, পুরুষের জন্যও না।
এই বাস্তবতায় এই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে তাই নারীবাদ চর্চাকে আরও বহুকাল বহু অন্ধকার মোকাবেলা করেই এগুতে হবে। তবুও গত ৩০/৪০ বছরের নারী আন্দোলন, আলোচনা, প্রচার ইত্যাদির কারনে বাংলাদেশে যখনই নারীরা (কিছু পুরুষ ও) নারীবাদকে বুঝতে চাইছে, কথা বলছে, অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চাইছে, তখন অনেক পুরুষ প্রচার মাধ্যমে বা গবেষণায় নারীবাদ নিয়ে এমন উদ্দেশ্যমুলক বিতর্ক জুড়ে রাখে যে, নারীবাদ বলতে কেবল পুরুষ বিদ্বেষ, শ্রেণী বৈষম্য, পশ্চিমা তত্ত্ব আর এনজিও-জার্গাম খুঁজে।
এ অবস্থায় এসব উদ্দেশ্যমুলক বিতর্ক না বাড়িয়ে নারী পুরুষ উভয়কেই পুরুষতন্ত্রের এঁকে দেয়া গন্ডি পেরিয়ে নারীবাদকে জানতে হবে। সময় এসেছে সব সংশয় দূর করে নারীবাদকে পরিষ্কার করে বোঝার।
নারীবাদ মানেই পুরুষ বিদ্বেষ নয়, এক্সট্রিমিস্ট নয়, ডিভোর্স নয়, ফ্রী সেক্স নয়, মাতৃত্ববিরোধী নয়, পরিবার, সমাজ ছারকার করার বিপ্লব ও নয়। আবার নারীবাদ মানে নিশঃর্ত আত্মসমর্পন ও নয়। নারীবাদ মানে প্রশ্ন তোলা, অবিরাম প্রশ্ন তোলা এবং সকল বৈষম্যমুলক নিয়ম- কানুন-আচার-প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করা।
নারীবাদ এক রোমাঞ্চকর গতিশীল ভ্রমন, যেখানে ঘনিষ্ট সম্পর্কগুলোকে, একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাসগুলোকে পূণর্মুল্যায়ন করে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরবির্তন করতে শেখা যায়। নারীবাদ এমন এক জীবনব্যপী শিক্ষার নাম যা মনের অস্পষ্ট ধারনাগুলোকে ভাবায়, নতুন করে নির্মাণ করে, নিজেকে চিনতে, খনন করতে শেখায়।
নারীবাদ এমন একটি রাজনৈতিক তত্ত এবং চর্চা, যা পুরুষতন্ত্রের তৈরি সমস্ত পক্ষপাতমুলক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে সকল নারীকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করে। সন্তান জন্মদানের মতো একটি স্বাভাবিক ও জৈবিক প্রক্রিয়াকে পুঁজি করে নারীদের গর্ভ ও গর্ভজাত সন্তানকে অধিকার করার জন্য যুগ যুগ ধরে নারীর উপর যে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্য চলছে, তার প্রতিবাদই নারীবাদ।
নারীবাদ আমাদের একপেশে আপোসের দায়ভার থেকে, সম্মানহীন-অধিকারবিহীন সম্পর্ক থেকে মুক্ত হওয়ার শক্তি ও সাহস দিয়েছে, নিয়তির বিশ্বাস থেকে মুক্ত করেছে। এটিই সেই মতবাদ, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, বেশীর ভাগ সংসারের “শান্তিপূর্ণতা” হচ্ছে সামনের ছবি, যার পেছনে নারীর স্বপ্ন, অনূভূতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ এবং যোগ্যতার ভাঙ্গা টুকরো ছড়ানো। নারীবাদ এই ভাঙ্গা টুকরো গুলো এক করে একটি পূর্ণ, সত্যিকার শান্তির ছবি আঁকতে চায়, সমমর্যাদা ও ভারসাম্যপুর্ণ পরিবার গড়তে চায়।
নারীবাদ আমার কাছে এক আত্মিক যোগাযোগ এর নাম, যা আমার পূর্বনারীদের আত্মত্যাগ, আর্ত চিৎকার আর বলিদানকে বোঝার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সকল নিপীড়িত নারীর হাতে হাত ধরে, নিঃসঙ্গ ও নিরন্তর পথ তৈরি করেছে। নারীবাদ আমাদের সাথে সেসব নারীদের আত্মিক বন্ধন তৈরি করেছে যারা আমাদের আনন্দ বেদনার সহযাত্রী, যারা আমাদের বলা এবং না বলা কথা অনুভব করতে পারে, যারা আমাদের যা ইচ্ছা আলোচনা করার, প্রাণখুলে কাঁদার অথবা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার জায়গা করে দিয়েছে।
জানি তবুও অনেক নারী ভয় পান। মহা শক্তিমান পুরুষতন্ত্রের কোপে জোয়ান অবআর্ক, খনা, সুলতানা রাজিয়া, সীতারা যে আগুনে পোড়ে সে আগুন থেকে আজকের অনেক নারীই গা বাঁচিয়ে চলতে পারিনা। তবুও একটি সমতার পৃথিবীর জন্য নারীবাদের মতো একটি আন্দোলনকে সব রকম কুসংস্কার আর ট্যাবু থেকে মুক্ত করার জন্য মানবিক অবস্থান থেকে নারীবাদকে জানা এবং বোঝা জরুরী।
কারন, নারীবাদ না জানলে জানা হবেনা আমাদের মায়েদের উদায়স্ত বিনাশ্রম মজুরী, দাসজীবনের আর্তি, জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাদের, সহমরনের চিতায় পোড়ানো নারীদের, সতিচ্ছদ আর ভঙ্গাঙ্কুর কাটা কিশোরোদের আর্তচিতকারের ইতিহাস। নারীবাদ না বুঝলে আপনার কানে পৌঁছুবেনা ধর্ষিত মেয়েদের চিৎকার, এসিডে ঝলসে যাওয়া মুখ গুলোর আমৃত্যু যন্ত্রণার ভাষা।
কন্যা সন্তান জন্মের ভয়ে গর্ভপাত করতে বাধ্য হওয়া মায়ের নিরব কান্নার দহন, গর্ভজাত সন্তানের অধিকার বঞ্চিত মায়ের অসম্মান আর বঞ্চনা আপনি বুঝতে পারবেন না, যদি নারীবাদ না বুঝেন। নারীবাদের পক্ষে না হলে আপনি যৌন পল্লিতে যৌন সেবা দিতে বাধ্য হওয়া দশ বছরের মেয়েটির বিপক্ষে।
নারীবাদকে বুঝলে আপনি বুঝবেন, বদরুল নামের বন্য পুরুষের উন্মুক্ত চাপাতির আঘাতে রাজপথে লুটিয়ে পড়া খাদিজার নামই নারীবাদ, হিংস্র পুরুষ সাইফুলদের বিকৃত যৌনতায় শতছিন্ন যোনিপথ নিয়ে কাঁতারনো পুজা নামের শিশুটির নাম নারীবাদ। ধর্ষনের ভয়ে নিরন্তর গুটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মেয়েশিশুর জীবনের দাম নারীবাদ। আইসিস নামক ভয়ঙ্কর ধর্মদানবের যৌনদাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী থাকা, ভোগ করা শেষে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারা ইয়াজিদি নারী অথবা সৌদী বাদশার হেরেমে আটকে থাকা হাজার হাজার যৌন দাসীর মুক্তির সুর বাজে যে গানে, সেই সঙ্গীতের নাম নারীবাদ।
সেই সুর আপনি গাইবেন কিনা, সিদ্ধান্ত আপনার।
(দাস জীবনের মালিক, নারী?: সাদিয়া নাসরিন/ শ্রাবণ প্রকাশনী)