বিকল্প সংস্কৃতি, সংস্কৃতির বিকল্প
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০০:২৮
১
মিটিং শুরু হবে ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। তার আগে গুনে গুনে মোট সাড়ে সাত মিনিট সময়। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই গুটিয়ে আনতে হবে সমস্ত প্রতিবাদের সুর-তাল-লয় প্রভৃতি। অনুমতি ততটুকুরই আছে, সেটাই স্ট্রাকচার। এর বেশি হয়ে গেলে বিক্ষোভ আর কম পড়ে গেলে অভক্তি। একদম মাপে মাপ, খাপে খাপ। বিপ্লবের প্রাত্যহিক ডোজ। ‘বিকল্প সংস্কৃতি’।
অতএব তড়িঘড়ি গিটারের পিক-আপ লাগানো, হারমোনিয়ামের খাপ খোলা সবকিছুর জন্য বরাদ্দ দেড় মিনিট। গায়কের সুর ভেঁজে নেওয়ার জন্য পাঁচ সেকেণ্ড। তারপর কী আসতে চলেছে তা কেউ জানে না। গানের গরু বামন হয়ে চাঁদে জমি কিনবে, না হারমোনিয়ামে বাঁধা সুরের সাথে দশ কিলোমিটারের ফারাক রেখে চলবে, তা গায়ক/বাদকও জানেন না।
সুর লাগানোয়, তাল মেলানোয়, বা অন্ততপক্ষে গানের বাণী আত্মস্থ করা নিয়ে কোন আলোচনা সংগঠিত হয় না বিপ্লবের ময়দানে। বিকল্প সংস্কৃতি চর্চার জন্য বরাদ্দ করা হয় সেই ঠিক সাড়ে সাত মিনিটই। যার পর আরম্ভ হয় অশেষ সর্বেসর্বা বার্তালাপের সভা, যা আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক রাজনীতি চেতনার মতই বেসুরো, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং চূড়ান্ত অনাবদ্ধ, অনাসক্ত।
২
ছোটবেলায় আমাদের একটা বড় বাড়ি ছিল শিলচরে। সামনে-পেছনে দুখানা বিশাল উঠোন ফল-ফুলের গাছে ভরা, আছে অগুনতি মরসুমী আগাছার ঝোপও। সেই বাড়ির বসার ঘর থেকে হাঁক পাড়লে পেছনের ঘরগুলিতে আওয়াজ পৌঁছতো না। বাইরের বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেলে রান্নাঘর থেকে কেউ চিৎকার শুনে বাঁচাতে আসবে, এমন সম্ভাবনা কমই ছিল বেশ। কিন্ত অত বড় বাড়িখানায় মানুষ কেবল ৪-৫জন থাকতাম আমরা। অথচ আমাদের উঠোনের চারপাশের বাগানের মতই ওই বসার ঘরে অস্থায়ী মানুষের সংখ্যা কোনদিনই কম ছিল না, যার প্রভাব পড়তো রান্নাঘরের অনির্বাণ চুলোয় বসানো চায়ের পাত্রে। আমার পরিবার শুধু ওই বাড়িতে থাকতো না। আমারও কেবল ওই একটিমাত্র ঠিকানা ছিল না।
শিলচরে থাকাকালীন আমার বাবা গণনাট্য করতো। আর সেই গণনাট্য সম্পর্কিত লোকজনে ছেয়ে থাকতো আমাদের বাড়ি-জীবন, দিন-রাত সবকিছু। এতকিছুর পরও কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করেন যে শিলচর গণনাট্য সঙ্ঘের মূল অফিস কোথায় ছিল, আমি ঠিক বলতে পারব না। আমার স্মৃতিতে শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের হলঘর থেকে শহীদ ভবনের কমিউন, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির মঞ্চ থেকে শংকরী হোটেলের ভেতরের ঘর- সর্বত্র থইথই করতো গণনাট্য আন্দোলনের আগুন, স্পর্ধা, প্রশ্ন।
বাবার মুখে শুনেছি কোন এক বারের ভোটের গল্প। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের দিনেই নাকি সেবার ভোটগণনা। প্রসঙ্গত, গণনাট্যের সাথে জড়িত অনেকেই ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। প্রসাদকাকু, বাবারা সেদিন ‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার, জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ গাইতে গাইতে গণনাকেন্দ্রে ঢুকেছিল। গণনাট্য সঙ্ঘের অফিস কোথায় জানি না, তবে বিকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ওই ভোটকেন্দ্রেও হয়েছিল বলে আমি নিশ্চিত।
৩
ছোটবেলায় আমাদের কেবল একটা ঠিকানাই ছিল না, কারণ রাস্তা-ঘাটে আমাদের পরিবারের টুকরোদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যেতো। স্কুলফেরত মাঝেমাঝে দেখতে পেতাম রাস্তার মোড়ে কোথাও বাবা গাইছে, ‘ওরা ভয় পেয়েছে রোবসন!’, পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিধায়ক হওয়া দীপকজেঠুকে দেখতাম পেছনের কোন সারিতে চুপচাপ বসে গান শুনছেন। আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে যৌথ খামারের স্বপ্নে বিধায়ক মিশে থাকেন মানুষের ভিড়ে, গানের আসরে, বিজেপি-করা বাপ-মায়ের ছেলেমেয়েরা ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’-এ গলা মেলায়।
গণনাট্য সংঘ শিলচরের একখানা শিশু শাখা ছিল, ‘অংকুর’ নামে, যার সাথে জড়িত ছিলাম আমি-সহ আমার বাল্যকালের প্রায় সব বন্ধুরাই। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে আয়োজিত হত আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান, সুকুমারজয়ন্তী। অনুষ্ঠানলিপি, মঞ্চসজ্জা, সঞ্চালনা, গান-নাচ-নাটক-আবৃত্তি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার্ড বিতরণ- সব করতাম আমরা ছোটরাই। আর আমাদের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতো শিলচরের এক বিখ্যাত বেলুনওয়ালা, যার কন্ঠ ও আশ্চর্য ফেরির ডাক তাকে আমাদের হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার প্রতিরূপ করে তুলেছিল। ঘুমন্ত দুপুরে যখন সারা পাড়া নিস্তব্ধ, তখন দূর থেকে ভেসে আসত তার গলা- “সোনা বাবু আও, তাড়াতাড়ি আও, বাপরে বাপ!” আমাদের অথৈ স্বাধীনতায় জ্বলজ্বল করে উঠত ‘অংকুর’ আর গর্বিত বাবা-মায়ের মত গণনাট্যের বাবা-কাকা-জ্যাঠারা প্রশ্রয় দিতেন খুব। এতসব বলছি কারণ, সত্যিকার অর্থে ছোটদের যৌথ খামার হতে পেরেছিল ‘অংকুর’। বড়দের ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতাম না আমরা মোটেও। গলা ছেড়ে গাইতাম আমরা ‘আমাদের পাকবে না চুল গো, মোদের পাকবে না চুল’, বড় হতে তখন আর কেই বা চায়?
আসলে এই বড্ড বেশি বড় হতে চাওয়াটাই আমাদের সবার স্বপ্নের কাল হয়ে যায়। বড় গায়ক, বড় নৃত্যশিল্পী, বড় নেতা- আমাদের অসীম চাওয়ার ব্যপ্তিগুলিকে ধারণ করতে অক্ষম যৌথ খামারের সহজ স্বপ্ন। আমাদের সবার সাংস্কৃতিক চেতনা বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়। নিজেকে ছোট করে ভেঙে দিতে আর কেউ চায় না, ছোটদের হাতে, ক্ষমতাচ্যুতের হাতে আস্থা রাখতে সবাই অক্ষম।
আর যাদের হাতে সত্যিই ক্ষমতা অপার, তাদের আছে অনেক অনেক বক্তব্য শুধু, মাঠ-কাঁপানো গলা, অথচ ঠায় বসে দুটো কথা, দুটো গান শুনবার কান নেই, ধক নেই।
আমার স্বপ্নের গণনাট্যের একটা স্বপ্নালু কান ছিল, বাস্তবে এখন শুধু কিছু অফিস পড়ে আছে।
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী