আর কত গৌরীর মৃত্যু দরকার?
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:২৩
(১)
প্রফেসর কুলবার্গির কথা মনে আছে আপনাদের? নাকি ভুলে গুলে খেয়ে বসে আছেন? ঐ যে ভারতীয় সেক্যুলার লিবারেল প্রফেসর সাহেব, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও ছিলেন, সেই প্রফেসর কুলবার্গি। ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা ওকে ওর বাড়িতে এসে গুলি করে হত্যা করেছিল ২০১৫ সনে। একই প্যাটার্নে ওরা দুইদিন আগে হত্যা করেছে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে। সন্ধ্যাবেলায় ওর বাসার সামনে তিনি যখন গাড়ি থেকে নামছিলেন হত্যাকারীরা ওকে গুলি করে। তিনটি গুলি ওর গায়ে লেগেছে, আর একটি গুলি গৌরীকে স্পর্শ করে যায়। সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীরা হেলমেট পরা ছিল। ভারতজুড়ে সব সেক্যুলার লিবারেল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সংগঠন ও ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করছে।
কারা হত্যা করেছে গৌরীকে? তার আগে আপনাদেরকে বলে নিই কে ছিলেন এই গৌরী লঙ্কেশ। গৌরীর পিতা ছিলেন একজন কবি ও সাংবাদিক। লঙ্কেশ পত্রিকে নামে ওদের একটা সাপ্তাহিক কাগজ ছিল কন্নড় ভাষায়। ছিল বলছি তার কারণ কাগজটি যদিও এখনো আছে, কিন্তু তাতে গৌরীর আর স্থান ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর কিছুদিন গৌরী আর গৌরীর ভাই মিলে কাগজটি চালাতেন। গৌরী ছিলেন সম্পাদক আর ওর ভাই প্রকাশক। ভাই বোনের মধ্যে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। গৌরী কমিউনিস্ট ও বামদের পক্ষে লিখতেন, কথা বলতেন, সেটা ভাইয়ের পছন্দ ছিল না। পরে ওর ভাই একরকম জোর জবরদস্তি করে গৌরীকে হেনস্তা করে পত্রিকা থেকে বের করে দিয়েছে। ওর ভাইটা এমন শয়তান, গৌরীর বিরুদ্ধে পুলিশে মামলাও করেছিল- যে গৌরি নাকি পত্রিকার কম্পিউটার চুরি করেছে। বুঝেন।
এরপর গৌরী নিজের কাগজ বের করেছে। ওদের কয়েকজন মিলে কাগজটা চালায়- কোন বিজ্ঞাপন নেয় না।
(২)
গৌরীকে বলতে পারেন সাংবাদিক ও এক্টিভিস্ট। কিরকম কথাবার্তা বলতেন তিনি? তিনি উগ্র ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি কট্টর ছিলেন- গেল ইলেকশনের আগে আগে ওর কয়েকজন বন্ধু বিজেপির ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে বলে তিনি তাদের সাথে সকল সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এদের মধ্যে একজন তো ছিলেন তার অনেক পুরনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই যে হিন্দুত্ববাদি আরএসএস বজরঙ্গি দল এইসব আছে- এদের তিনি বিরোধিতা করতেন। এজন্যে এরা তাকে মাঝে মাঝে হুমকি টুমকি দিত। আর সোশ্যাল মিডিয়াতে গৌরীকে ক্রমাগত গালাগালি এইসব তো ছিলই। অনেকটা আমদের এখানকার মতোই- নিয়ম করে দল পাকিয়ে গৌরীকে ট্রল করতো যারা ওদের নেতৃত্বে ছিল বিজেপি ও বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজন। সরকারের আইটি বিষয়ক উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রী যাদেরকে টুইটারে ফলো করেন সেরকম লোকজন। আর এদের ভাষা ও ট্রল করার ধরণও ঐ আমাদের এখানে সেক্যুলার ধরনের নারীদেরকে যে ভাষায় ট্রল করা হয়, ঠিক ঐরকম। গৌরী মেয়েদের পক্ষে তো কথা বলতেনই, হিন্দু ধর্মে যে জাত পাতের বিধান আছে সেগুলিরও সমালোচক ছিলেন। আর 'ছোটজাতের' লোকদের প্রতি যে অন্যায় হয় ইন্ডিয়ায় তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। আর সাধারণভাবে এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট ছিলেন। কংগ্রেসেরও বড় সমালোচক ছিলেন গৌরি।
আর যে কারণে গৌরীকে আমার আপন মনে হয়েছে সবসময়- গৌরী সবসময়ই লিবার্টি লিবার্টি করে চিৎকার করেছেন। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা, চেতনার স্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, খবরের কাগজের স্বাধীনতা- এইগুলি ছিল ওর নিত্যদিনের কথার প্রসঙ্গ।
(৩)
তাহলে গৌরীর মৃত্যু কামনা কারা করতে পারে সেকথা কি আপনাদেরকে এখনো ভেঙে বলতে হবে? তাহলে শোনেন। গৌরীর মৃত্যুর পর বিজেপি আরএসএসএর সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন ফেসবুকে টুইটারে উল্লাস প্রকাশ করছে। আমি দুই একটা টুইটার ও ফেসবুক পোস্ট দেখেছি। 'যেয়সা করনি ওয়ায়সা ভরণী' 'আরেকজন কমি মরেছে, ভালোই হইছে' এইগুলি হচ্ছে ভদ্র পোস্ট। খারাপ পোস্টগুলি আর বললাম না। আপনারা অনুমান করতে পারেন। যারা এইসব পোস্ট দিচ্ছে, গৌরীর মৃত্যুতে আনন্দিত হয়ে, এদের মধ্যে আছে ওরাই- আরএসএস, বিজেপি, বজরং এইসব। নাম ধাম লুকোচ্ছে না ওরা, একদম অফিসিয়াল ডেজিগনেশন সহ একেকজনের আইডি।
আর গৌরীর মৃত্যুতে প্রতিবাদ করছে কারা? এক জায়গায় দেখলাম নন্দিতা দাস একটা মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য যেসব ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীর নাম আপনারা মাঝে মাঝে শোনেন সেক্যুলার লিবারেল বা বামপন্থী হিসাবে, সকলেই রাস্তায় নেমেছেন- প্রতিবাদ করছেন। সিপিআই প্রতিবাদ করছে সারা দেশ জুড়ে। সিপিএম আছে। কংগ্রেস আছে। মমতা ব্যানার্জিও সম্ভবত একটা কর্মসূচী নিয়েছেন। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী সহ সকলেই প্রতিবাদ করছেন, বিচার দাবি করেছেন। আর সকলেরই অভিযোগের আঙ্গুল বিজেপি-আরএসএসএর দিকে।
আমাদের এখানে খবরের কাগজে সেইভাবে খবরটা আসেনি। হয়তো এসেছে, আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু খবরটা তো আমাদের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ গৌরী তো আমার বোন আমার কমরেড- ব্যক্তিগতভাবে ওকে চিনি কি চিনি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা তো আমাদের নিজের নিজের জায়গা থেকে মানুষের বাক চিন্তা ও প্রকাশের স্বাধীনতার কথাই বলছি। শারীরিকভাবে একই সাথে কখনো আমরা হাঁটি নাই বটে- কিন্তু আমি আর গৌরী তো একই মিছিলেই ছিলাম আর একই মিছিলেই আছি।
রাষ্ট্র হিসাবে আর নাগরিক হিসাবে আমাদের দেশের সকলের জন্যেও গৌরীর হত্যাকাণ্ডটা একটা সংকেত- আমাদের এখানেও কিছু করণীয় আছে।
(৪)
আমাদের কি করণীয়? বা গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যু নিয়ে আমরা উদ্বিগ্নই বা কেন হবো বা ব্যথিতই বা কেন হবো?
নন্দিতা দাসকে দেখলাম একটা মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছোট মিছিল, কিন্তু মিছিলের সকলেই খুবই আবেগাপ্লুত। মিছিল শেষে নন্দিতা বলছিলেন, 'আমরা এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি যে এইরকম একেকটা মৃত্যু বা সেরকম কোন ঘটনা না ঘটলে আর আমরা এক হচ্ছি না, একে অপরের কুশলও জানতে চেষ্টা করি না। এমন কি এই যে একেকজনের মৃত্যুতে আমরা একত্রিত হই আর এই উপলক্ষ্যে কে কেমন আছেন জানতে পারি, এই একত্রিত হওয়াদের সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসছে। আমরা কি তবে ভয় পেয়েছি? আমাদের কেউ কেউ কি তবে ভয় পেয়ে বসে গেছেন চুপচাপ নিজের ঘরে?'
আর গৌরীরই একটা টুইট দেখলাম যেখানে তিনি বলেছেন, "why do i feel that some of `us' are fighting between ourselves? we all know our ``biggest enemy''. can we all please concentrate on that?"
নন্দিতার বক্তৃতাটা আর গৌরীর এই টুইটটা দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে? আপনারও কি মনে হচ্ছে না যে আমরাও কেবল এইরকম একেকটা ঘটনা ঘটলে একসাথে দাঁড়াই আর সেই উপলক্ষে একজন আরেকজনের কুশলাদি জানি, খবরাখবর নিই? আপনারও কি মনে হচ্ছে না এই একসাথে দাঁড়ানোর সংখ্যাটাও কমে আসছে দিনকে দিন?
আপনারও কি মনে হয় না যে আমরা আমদের 'biggest enemy' কে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিটা বেশি বেশি করছি? ভেবে দেখুন তো! আপনার ফেসবুক এক্টিভিটি ঘেঁটে দেখেন তো- গত এক বছরে আপনি যা করেছেন সেটা গৌরীর টুইটের সাথে মিলে যায় কিনা?
(৫)
না, শোক আমি করি না। কারণ গৌরী নিজেও কোনদিন মৃত্যুকে একটি ভয়াবহ ঘটনা মনে করেননি। গৌরী বয়সে আমার কাছাকাছিই ছিল- এক দুই বছরের বড় বা ছোট হতে পারে হয়তো। আজ গৌরীকে ওরা মেরেছে ভারতে, কাল যে আমাকে এই বাংলাদেশে আমাকে ওরা মারবে না সেই নিশ্চয়তা কি আছে? নেই। আমার বা আমার মতো আরও একজনের বা কয়েকজনের মৃত্যুর পরে কি আপনাদের শিক্ষা হবে?
মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে আর ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আপনাকে রাস্তার ডেকে আনার জন্যে আর কয়জনের মৃত্যু দরকার হবে বলেন তো?
লেখক: আইনজীবী