জঙ্গিবাদের বীজ বহনকারীর ব্যাধি আমাদেরই ব্যাধি
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০১৬, ১৪:২৯
গুলশান ঘটনা পায়ের তলার মাটি ধরে টান দিয়েছে আমার। শুধু আমার না, সমস্ত বাঙালির। হতভম্ব ভাবটা কাটছেনা কিছুতেই। বাঙালির আত্মা গঠিত মানবতাবাদ দিয়ে। একি শুধু কথার কথা?? এদেশের আত্মায় কি বাস করে না রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মহাত্মা লালন, চন্ডিদাস কিংবা মহামতি বুদ্ধ? সেই উদারতা কি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেনি প্রফেট (সঃ) এর উদার মানব দর্শনকে আপন করে নিতে? এতো স্বীকার করতেই হবে আমরা যতটা না যুক্তিবাদী তার থেকে অনেক বেশী মানবতাবাদী।
অতীতে একথা বহুবার প্রমাণিত, আমাদের আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে যতবারই উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এদেশে তার বিস্তারটা সেভাবে হতে পারেনি। আমাদের ভক্তিবাদ মানবতাবাদ আমাদেরকে রক্ষা করেছে। তাই জঙ্গিবাদের নামে এই ভয়ংকর অনাচার যদি শেষ পর্যন্ত নিজের আসন পাকাপোক্ত করে ফেলে তাহলে তা শুধু অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে না, তা মেরে ফেলবে এদেশের আত্মাকেও। আর যে জাতির আত্মার মৃত্যু ঘটে তাকে তো কেউ রক্ষা করতে পারবে না। যে করেই হোক সেই আশ্চর্য মানিককে বাঁচাতে হবে। মরিয়া হয়ে এর প্রতিরোধে নামতে হবে।
আর আজ মনে হচ্ছে প্রতিরোধের যত উপায় জানি সব ভুল। দুই দলে ভাগ হয়ে হবে না এর প্রতিকার। আমরা সবাই সমান। আমাদের মাঝে যে জঙ্গিবাদের বীজ বহন করছে তার ব্যাধি আমাদেরই ব্যাধি। তার ভার বহন করতে আমাদেরকেই এগিয়ে যেতে হবে। আমার মধ্যে যদি আলো থাকে বিন্দুমাত্র তার কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।
আজ যে মরেছে তারাই শুধু ভয়াবহ নৃশংসতার বলি হয়নি, যারা মেরেছে তারাও হয়েছে। তাদের কথা কি আমরা শুনতে চেয়েছি কখনো? কোন দুঃসহ আবেগে তারা পঙ্গপালের মত আগুনকে বেছে নিলো তার অবস্থান জানার চেষ্টা করেছি কি? সে ইংলিশ মিডিয়াম হোক কি মাদ্রাসা হোক, এতটুকু এতটুকু বাচ্চাগুলো কেনো এরকম হলো?
জানতে হবে। এর জন্য কথা বলতে হবে আমাদের। আর রাখঢাক বলে কিছু রাখা যাবে না। আমি অবিশ্বাসী তাই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে বিশ্বাসীদের কাছ থেকে, কিংবা আমি বিশ্বাসী তাই যুক্তিবাদীরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। বেঁচে থাকার জন্যে এ কোন টেকনিকই নয়।
আজ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাই মরছে। বরং মধ্যপন্থীরা কিছুটা গা বাঁচিয়ে চলতে পারছে। তাই কথা বলতেই হবে। আমার বোধ কিংবা জ্ঞানের আলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এখন ঈমানী দ্বায়িত্ব। তার বিশ্বাসের ভিতরকার সত্যটাকেও জানতে হবে। যারা আজ নিজের বিশ্বাসের জন্য কিছু একটা করতে এতটা মরিয়া তারা যদি ঠিক পথে চালিত হতো তাহলে সত্য সুন্দরের জন্যও অনায়াসে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকতো। তাই তার কাছে পৌঁছানো জরুরি। তাকেও আমাদের কাছে টেনে আনতে হবে। এই মেলবন্ধনেই শক্তিশালী হবে মানবাত্মা।
আর সেই শক্তিকে দমানো সম্ভব না তৃতীয় পক্ষ কিংবা ভিনদেশী চক্রান্তকারীদের পক্ষে। কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই। শুভবোধের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক শ্রেণি পেশার মানুষের আন্তঃযোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক জায়গা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে। সুবিধা বঞ্চিত, শিক্ষার আলো বঞ্চিত মানুষদের কাছে প্রতিনিধি পাঠাতে হবে তাদেরই কাউকে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবনবোধ, মনস্তাত্বিক সংকট সব জানতে হবে। সেই অনুযায়ী তাদের জীবন যাপনের সামাজিক রাষ্ট্রীয় রুপরেখা তৈরী করতে হবে।
উচ্চবিত্তের অল্পবয়সী তরুনেরাও জড়াচ্ছে এসবে। তাদের ভাষা, সংকট, তাড়না বুঝতে তাদের মধ্য থেকেই প্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠাতে হবে তাদের কাছে। ঘরে কথা বলতে হবে, বাইরে কথা বলতে হবে, কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ অবাধ করতে হবে। কোন উপায় নেই আর। আর কেউ বসে না থাকুক। প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা নিক। সাংবাদিক তার মাধ্যমে বলুক, লেখক লিখুক, সমাজবিদ রাজনীতিবিদ তার কাজে আরো আন্তরিক হোক, মনোবিজ্ঞানী অন্যে্র মনের উন্নয়নে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করুক, ইতিহাসবিদ ইতিহাস ঘেঁটে এর সমাধান বের করুক। আর সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গবেষণায় উন্নত হোক মানব বিজ্ঞান।
আমি সেই সব মানুষদের কথা বলছি যারা এইসব ভয়ংকর ঘটনার প্রতিকার চান মরিয়া হয়ে। সবাই কর্মে ধর্মে এর প্রতিরোধে উচ্চকিত হওয়া ছাড়া আর কোন সমাধান দেখা যাচ্ছে না।
শুধুমাত্র দমন নীতি আর আইন করে রুখবার জিনিস এ নয়। কারণ রাষ্টযন্ত্র যদি মানবতার দীক্ষা না নেয়, সৌন্দর্যের পাঠ না নেয়, নাগরিকের জন্যে যদি আন্তরিক মমতা বোধ না করে তাহলে কিছুই আমাদের এই তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে না। আর সেই রাষ্ট্র তৈরি করার দ্বায়িত্বও আমাদেরই। সঠিক রাষ্ট্রনেতাকেও নির্বাচন করতে হবে। সেই মানের কোন নেতা যদি না থাকে তাহলে তা তৈরি করে নিতে হবে। এর অবহেলায় নিস্তার নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী