বাঁচুন, প্রাণ খুলে বাঁচুন!
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০১৭, ১৯:৪৯
ড: মেহতাব আপার কাছে আমি মাঝে মাঝেই যাই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শেখার জন্য। গত পাঁচ বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। আমি জানি কিভাবে জীবনকে ফেস করতে হয়। আমার জীবনে এতো চড়াই উতরাই গেছে, বিষন্নতা আমার কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। অথচ এক ঘন বর্ষার রাতে কি হয়ে গেলো, কোন কারণ ছাড়াই আমি ভয়ংকর অবসাদে ভুগতে শুরু করলাম। জানি না, হরমোনাল ইমব্যালেন্স কিনা। তাছাড়া, ডিপ্রেশন আমাদের জেনেটিক সমস্যাও।
তো সেই অবসাদ টানা দু'মাস ধরে আমাকে ছিবড়ে করে দিচ্ছিলো। এই বিষাদ এতো ভয়ংকর যে, আমার দিন শুরু হতো মৃত্যু কত সুন্দর এবং তা আমার জন্য কতো জরুরী সেই চিন্তা দিয়ে। আমি ঘর সংসার, লেখালেখি, অফিস, বাচ্চা কোন কিছুতেই মন লাগাতে পারতাম না। আমার শুভাজনরা খুব অবাক হয়েছে আমার মতো স্ট্রং পার্সোনাল একজন বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে পারে তা ভেবে। ওরা ভেবে পায় না, আমার কি নেই!
অথচ একটা বিষয় খুব পরিষ্কার, তা হলো, যে কোন প্রাণচঞ্চল মানুষও যে কোন সময় অবসাদে ভুগতে পারেন। মেহতাব আপা বলেছেন উনি নিজেই নাকি প্রায়ই সিনিয়র এর কাছে থেরাপি নেন। আর আমরা যারা সারাদিন কমপক্ষে দশ বারোজনের দুঃখ বেদনার সঙ্গী হই, তাদের জন্য ব্যাপারটা আরো নাজুক।
'ভুগছিলাম' 'পারতাম না' বলে অতীত বাচ্যে লিখছি এই জন্য যে, আজ থেকে পাঁচদিন আগে এক সুন্দর সকালে আমি সমস্ত বিষন্নতা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলতে পারলাম। কিভাবে কি হলো জানি না, আমার হঠাৎ মনে হলো, আমি সাদিয়া নাসরিন। বহু রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে আমি এখানে এসেছি। আমি অনেক মূল্যবান। এ জীবন আমার তৈরী। কেউ একজন চাইলেই আমাকে অ্যাবিউজ করতে পারে না, উপেক্ষা করতে পারে না।
উপেক্ষাকে উপেক্ষা দিয়ে যেদিন পোড়াতে পারলাম সেদিন আমার মুক্তি ঘটলো। ক্লান্তি কোথায় উবে গেছে আমার!!! জীবন এতো সুন্দর!!!
এখন আমি নিয়ম করে অফিস করি, দু'হাতে কবিতা লিখি, তুমুল বই পড়ি, বইমেলার পাণ্ডুলিপি রেডি করি, জিমে যাই (অলরেডি আড়াই কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছি!), নিজেরে সাজাই, একা একা পাংখা হয়ে যাই, ঘুরে বেড়াই বিন্দাস, বাচ্চাদের সাথে ল্যাপ্টালেপ্টি করি, রোজ রাতে গান কবিতার আসর বসে আমার ঘরে। আমার হাঁড়ি পাতিল পর্দা চাদর কতোদিন পর আমার স্পর্শ পেয়েছে!! ওরাও বেঁচে ওঠেছে!!!
আমার বন্ধুরা আমাকে বুক দিয়ে আগলে এই ডিপ্রেশন থেকে বের করে এনেছে জীবনের ময়দানে এনে দাঁড় করিয়েছে। তোরা এতো ভালো কেন বাসিস আমাকে সেটা জানা জরুরী।
বিষন্নতাকে সঙ্গী করে যারা বেঁচে আছেন, প্লিজ ফিরে আসুন। একে স্বীকার করুন। এতে কোন ট্যাবু নেই। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিন। পেট খারাপ হলে ডাক্তার দেখান যখন, মন খারাপ হলেও ডাক্তার দেখান। পেটের মতোই মনও জরুরী।
বিছানায় পরিষ্কার চাদর বিছান, রঙিন পর্দা লাগান জানালায়। জোরে গান করুন। একা একা নিজের সাথে সময় কাটান, তবে ঘরে নয়, বাইরের আলো হাওয়ায়। যা ইচ্ছা তা করুন, ঝগড়া বাদে। অসুন্দরকে উপেক্ষা করতে শিখুন। যার কাছে আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আপনার দরজাও তার জন্য বন্ধ করুন।
বাচ্চাদের গায়ের ঘ্রাণ নিন। তবে সব সময় বাচ্চা পালতে থাকলে আপনি মনোটোনাস হতে পারেন। মনে রাখবেন, মা হয়েছেন বলে আপনার যাবজ্জীবন হয়নি। নিজের জন্য একটা জানালা অন্তত খুলে রাখুন। বন্ধু তৈরী করুন। হোক ছেলে কিংবা মেয়ে। যার সঙ্গ আপনাকে আনন্দে রাখে তার সঙ্গ করুন।
আর ভাবুন তো একবার, পেছনের কতগুলো বছর আমরা ইচ্ছে অনিচ্ছেয় একই রকম একঘেয়ে কাজ করে যাচ্ছি! আমরা মধ্য বয়সের কাছাকাছি এসেছি। এটা লাভিং এজ। এই বয়সে শরীর মন যত্ন চায়, আদর চায়, প্রেম চায়। আবার বিভিন্ন শারীরিক মানসিক জটিলতা তৈরী হওয়ারও সময়। তাই এখনই সময় নিজেরে ভালোবাসার। নিজেরে সাজান, নিজের লুক চেঞ্জ করুন। জিমে যান, ব্যায়াম করুন। বান্দীগিরি করা ছাড়া আরো অনেক কাজ আছে করার।
মনে রাখবেন, লক্ষ জীবনের সাধনায় এই মানব জীবন মেলে। যা করার এই জীবনেই করুন। বাঁচুন, প্রাণ খুলে বাঁচুন।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ