শাবানাকে আমরা এত ভালোবাসি কেন?
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৭, ২১:৪৯
শাবানাকে আমরা এতো ভালোবাসি কেন? এই প্রশ্ন ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় ঘুরে। সিনেমা হলে গিয়ে শাবানা অভিনীত আমার দেখা প্রথম সিনেমার নাম 'রজনীগন্ধা'। সাদাকালো সিনেমা। গল্পটা এরকম। রাজ্জ্বাক বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে। বাজে মেয়েদের সাথে তার ওঠাবসা, মদ খায়, ব্যবসায় মন নাই। রাজ্জ্বাক এর মা ছেলেকে পথে আনার মানসে ছোটবেলার বান্ধবীর (বান্ধবীর অবস্থা খারাপ, তারা গরীব) রূপে-গুণে অতুলনীয়, ভদ্র নম্র, নামাজী শাবানার সাথে বিয়ে দেন। বিয়ে দেয়ার পরপর মারাও যান এবং মরার আগে বলে যান তার ছেলেকে সংসার এবং ব্যবসায় মনোযোগ ফেরানোর সব দায়দায়িত্ব বউমা শাবানার।
ওদিকে রাজ্জ্বাকের বড়লোকী স্বভাব, পার্টি করে বেড়ানো, একটা খুবই লোভী, খারাপ, 'নষ্টা চরিত্রের' স্লিভলেস ব্লাউজ পড়া বান্ধবীর সাথে মেশা এইসবের কোনকিছুই বন্ধ হয় না। শাবানা কেঁদেকেটে, হাতেপায়ে ধরে, নিজের সব পবিত্রতা-শুদ্ধতা দিয়ে স্বামীকে ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিসের কি। 'দুশ্চরিত্র' রাজ্জ্বাক শাবানাকে কিছুতেই জায়গা দেয় না। তার কোনকিছুই কোন কাজে লাগে না। শেষে আরও কি কি হয় অত মনে নাই। শুধু শেষের দিকে একটা পার্টিতে হাল ছেড়ে দেওয়া শাবানা বেনারসী শাড়ি পড়ে পিয়ানো বাজিয়ে "আমি রজনীগন্ধ্যা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাবো" গান গেয়ে স্বামীর মন ফিরিয়ে আনেন সেইটা মনে পড়ে।
আরেকটা সিনেমায়, স্বামীর বাবা হওয়ার অক্ষমতাকে স্বামীর এবং সমাজের সামনে নিজের অক্ষমতা বলে ঘোষণা দেন তিনি। 'বন্ধ্যাত্ব'র অপমান নিজের গায়ে নেন এবং পরে আবার যখন পরিচালক দেখান যে ডাক্তারের রিপোর্ট ভুল ছিল অর্থাৎ তার স্বামী সন্তান জন্মদানে অক্ষম নন এবং শাবানা প্রেগনেন্ট হন তখন আবার সমাজের কাছে দুশ্চরিত্রার খেতাব পান।
এরকম আরও শত শত সিনেমায় তিনি স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দ্বারা প্রতিবাদহীন নির্যাতিতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানানো ছাড়া তিনি কিছু করেননি। দৈবক্রমে যদিও সতী নারীর সব দুঃখই একসময় শেষ হয় এবং স্বামী যখন ভুল বুঝে তার কাছে মাফ চাইতে আসেন তিনি স্বামীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলেন, "ওগো তুমি আমার স্বামী, ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী করো না"।
তো এই শাবানা চলচ্চিত্র ছেড়ে দিলেন। ছাড়ার আগেই পত্রিকায় তার সম্পর্কে নিউজ আসতো বা তিনি সাক্ষাতকারেও বলতেন যে, প্রতিদিন ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি শ্যুটিং শুরু করেন (জোহর, আসর, মাগরিব, এশা পড়তেন কিনা তা বলেন নাই) আমাদের আপামর দর্শক তার ব্যক্তিজীবন এবং অভিনয় জীবন খুবই পছন্দ করতেন। চলচ্চিত্র ছেড়ে তিনি যখন আমেরিকায় চলে গেলেন তখনও 'শাবানার মতো নায়িকা'র চলচ্চিত্র ছেড়ে যাওয়ায় হাহাকার রব উঠেছিল। মাঝেমাঝে তিনি দেশে আসেন। কাছের লোকেরাই কেবল তার পর্দা করা চেহারা দেখতে পান। এসব নিয়ে কেউ কিছু বলে নাই কোনদিন।
এই যে একজন শিল্পী নারীর অবমাননা হয় এরকম শত শত সিনেমায় দিনের পর দিন অভিনয় করে গেলেন, নারী মানেই দুর্বল, অধঃস্তন, নারীর চরিত্র খুব অল্পতে খোয়া যায়- এরকম জঘন্য সব চরিত্র তিনি ফুলের পবিত্রতায় ফুটিয়ে তুললেন, একটা অগ্রসর সমাজ গড়তে এইসব সিনেমা ঠিক কি ভূমিকা রাখল তা নিয়েও আমরা কেউ কোন কথা বলিনি। বরং আমাদের ভ্রষ্ট, হিপোক্রেট, ঘোমটার নীচে খেমটা নাচা পুরুষ দর্শককূল তারে মাথায় করে রেখেছে। শাবানার এইরকম পতিসেবা, এইরকম প্রতিবাদহীন নির্যাতন মেনে নেওয়া, এইরকম স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে কান্না, এইরকম স্বামীর সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়াই হলো আমাদের এখানকার আদর্শ নারীর আয়না। তার মতো 'আদর্শ' হতে চেয়েছে বাংলার নারীরা আর সেই পালে জোর হাওয়া দিয়ে গেছে পুরুষেরা।
তো শাবানার আমেরিকা গমন বা কোনকিছুর জন্যই তো কিছু থেমে থাকে নাই। আমাদের চলচ্চিত্র যাই হোক এগিয়েছে। অথবা আগায়নি অন্ততঃ শাবানার প্যানপ্যানানি থেকে তো মুক্তি পেয়েছে। অন্ততঃ আমার তাই ধারণা ছিল। এখন এতোদিন পরে আপাদমস্তক আবৃতা শাবানা যখন চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মননা নিতে আসলেন তখন তার কতকগুলি ভ্রষ্টতা আবার আমাদের সামনে চলে আসে। প্রথমত তিনি অভিনয় জীবন এবং চলচ্চিত্র থেকে তওবা পড়ে বিদায় নিয়েও সেই আখের এর গুড় খেতে ভুল করলেন না অর্থাৎ আজীবন সম্মাননা নিতে ভুল করলেন না অথবা চলচ্চিত্রের আদর্শ নারীর ইমেজ খাটিয়ে স্বামীর জন্য নমিনেশন নিতে ভুল করলেন না। (অথবা কে জানে আওয়ামী লীগও হয়তো তার 'আদর্শ নারী' ক্যারেক্টারকে কাজে লাগাচ্ছেন)
কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বড় যেটা মনে হচ্ছে সেটা হলো, এই যে শাবানা সারাজীবন পরিচালকের বানানো চরিত্রে অভিনয় করে গেলেন, নিজে পরিচালকের ভূমিকায় যেতে পারলেন না, শিল্পের কোন দায়বোধই কোনদিন ভেতরে নিলেন না, সমাজের প্রতি কোন দায়িত্বই পালন করলেন না, তার মতো অভিনেত্রীকে নিয়ে সমালোচনা হলে লোকে যেভাবে তাকে ডিফেন্ড করে সেইটা একটা সিগনিফিকেন্ট ঘটনা। আমার এক বান্ধবী ছিল রোকেয়া হলে, প্রাইভেট টিউশনি পড়াতো, কিরকম পড়াস জানতে চাইলে সে বুদ্ধদেব গুহর থেকে ধার নিয়ে বলতো, "যেমন পাই, তেমন পড়াই" মানে যেমন স্যালারি তেমন পড়ানোর অবস্থা। এখন মনে হয় আমাদের যেমন দর্শকরুচি আমাদের অভিনেত্রীও তেমন। এই শিল্পী নামের আবর্জনাগুলি আসলে শিল্পের নামে বন্ধ্যাত্ব জন্ম দেয়, মুক্ত আকাশের পরিবর্তে মানুষকে বিশেষতঃ নারীকে একটা ঘেরাটোপ উপহার দেয়-এই শিল্পীকে এখনও আমাদের সমাজ, আমাদের পুরুষকূল এবং অদ্ভুতভাবে নারীরাও ক্রমাগত ডিফেন্ড করতে থাকে।
শাবানাকে কেন আমরা, আমাদের সোসাইটি এতো পছন্দ করে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম শুরুতে, সম্ভবত উত্তরটা হলো, নারীকে অধঃস্থন, আবৃতা, গলা তুলে কথা না বলা, পিঠে চাবুকের আঘাত সহ্য করা অর্ধমানব হিসেবে দেখতে যেকারণে সবাই ভালোবাসে, শাবানাকেও ঠিক সেই কারণেই ভালোবাসে।
লেখক: সাংবাদিক