কেন কাতারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ?
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০১৭, ০১:৩৫
সৌদি আরবসহ বিশ্বের সাতটি দেশ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। দেশগুলো শুধু কূটনৈতিক সম্পর্কই ছিন্ন করেনি, তারা কাতারের সঙ্গে বিমান, জল ও স্থলপথে সব যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে গত সোমবার উপসাগরীয় এই রাষ্ট্রকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, লিবিয়া ও মালদ্বীপ।
কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেওয়ার পর চারটি দেশ কাতারের নাগরিকদের সেসব দেশ থেকে চলে যাওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়। এদিকে সৌদি, মিসর, আমিরাত ও বাহরাইনের নাগরিকদের জন্য কাতার ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাতারের জনসংখ্যা মাত্র ২৭ লাখ, যাদের অধিকাংশই প্রবাসী। ব্যাপক গ্যাসসম্পদ দেশটিকে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে এবং দেশটি এশিয়া ও ইউরোপের তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী। লন্ডনের শার্ড বিল্ডিং ও হ্যারোডস ডিপার্টমেন্ট স্টোরসহ যুক্তরাজ্যে কাতারের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশেও কাতার বিনিয়োগ করেছে।
কাতারের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব কী?
কাতারের ওপর এর প্রভাব হবে গভীর। কেননা, কাতার তার খাদ্যসামগ্রী আমদানির অর্ধেকটা করে সৌদি আরবের সঙ্গে সীমান্তপথে। স্থলপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় তা কাতারের নির্মাণশিল্পের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং ২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য দোহার সক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
বিমান চলাচলের ওপরও প্রভাব পড়বে। কাতার এয়ারওয়েজ বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান বিমান সংস্থাগুলোর একটি। সৌদি আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ায় এর পশ্চিমমুখী ফ্লাইটগুলো আর চলতে পারবে না। ইতিমধ্যে কাতারগামী বিমান চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান সংস্থা এমিরেটস ও ইতিহাদ।
রিয়াদ ও আবুধাবি বলেছে, দোহায় পৌঁছানোর জন্য অন্যান্য দেশ যাতে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার না করে, সে জন্য তারা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে এসবের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে কাতারের ডলফিন পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ স্থগিত হয়ে যেতে পারে, যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশটি।
কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?
ইসলামি আন্দোলনগুলোর প্রতি কাতারের সমর্থন তার আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ জন্য কাতারের ব্যাপক সমালোচনা করেছে আবুধাবি। আবুধাবির মতে, কাতারের রাজনৈতিক ইসলামকে প্রশ্রয় দেওয়া, বিশেষ করে ইসলামি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনের জঙ্গি সংগঠন হামাসের সঙ্গে সখ্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার বহু বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধে লিপ্ত। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই যাচ্ছে। ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ ইয়াসেফ আল-কারাদায়ির বাড়ি কাতারে। দেশটি সৌদি ও আমিরাতের নাগরিকসহ রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে গড়ে উঠেছে।
অভিযোগ আছে, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত ইসলামপন্থী দল ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়েছে কাতার। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে চায় যে ইসলামপন্থী দলগুলো, কাতার তাদের সবচেয়ে বড় সমর্থক। সমালোচকেরা বলছেন, ইসলামপন্থীদের সমর্থনের মধ্য দিয়ে কাতার পরোক্ষভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করছে, যেমন তাহরির আল-শামের মতো সংগঠন, যারা পণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দেয়।
সৌদি আরবও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থক। তবে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি ইসলামপন্থীদের প্রত্যক্ষ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করেছে। পশ্চিমা সমালোচকেরা সন্ত্রাসীদের সহায়তা করার জন্য দোহার কড়া সমালোচনা করেছেন। মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও লিবিয়ায় ইসলামি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য কাতার ও তুরস্ককে অভিযুক্ত করেছে।
আঞ্চলিকভাবে দোহার সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। তারা উভয় সিরিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করার নীতি গ্রহণ করেছে। তুরস্ক কাতারে একটি সামরিক ঘাঁটিও খুলেছে।
কাতার অবশ্য বলছে, ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করার মধ্যে কোনো ভুল নেই; কেননা তাদের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তবে দেশটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে।
কাতার ও ইরানের মধ্যে সংযোগগুলো কী কী?
রিয়াদ-আবুধাবি জোট সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইরানের শিয়াদের প্রতি দোহার সমর্থন বৃদ্ধি পেতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইরানের সঙ্গে গ্যাসফিল্ড ভাগাভাগি করায় ইরানের প্রতি সুন্নি রাষ্ট্র কাতারের নমনীয় অবস্থানেরই ইঙ্গিত দেয়।
দোহা সব সময় তার নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য গর্ব করে। কারণ, লেবানন থেকে সুদান পর্যন্ত আঞ্চলিক সংঘাতগুলোতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে দোহা তার প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু দোহার সমালোচকেরা বলছে, এ ধরনের নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা উপসাগরীয় সুন্নি দেশগুলোর স্বার্থে সক্রিয়ভাবে আঘাতকারী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের নামান্তর মাত্র।
কাতারের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহসহ ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে কোটি কোটি ডলার দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গত বছর ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে জিম্মি করা কাতারিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে কাতার এই অর্থ দেয়। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও বাহরাইনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য রিয়াদ তেহরানকে অভিযুক্ত করেছে। তারা এটাকে ইরানের অনধিকার চর্চা হিসেবে অভিহিত করেছে।
কেন এখন?
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের প্রচারযুদ্ধ কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। দোহা দাবি করে, গত মাসে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির একটি বক্তব্য প্রকাশ করার পর তাদের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে। আমির তাঁর ওই বক্তব্যে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং ইরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং সৌদি আরবের সমালোচনা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব। সম্ভবত এ ঘটনাই সৌদি আরবসহ অন্য ছয় দেশকে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে উৎসাহিত করেছে।
কাতারের রাষ্ট্রমালিকানাধীন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরা এই সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতাইবার লিখিত ই-মেইলের ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই মেইলটি হ্যাকাররা হ্যাক করেছে। এবং সেখানে কাতারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন্য নীলনকশার উল্লেখ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দেয় সৌদি আরবে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর। সৌদি আরব সফরের সময় ট্রাম্প আরব বিশ্বে ইরানের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রিয়াদের নেতৃত্বকে সমর্থন করেন। ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন, তেহরানের প্রভাব মোকাবিলায় এবং আইএসের মতো সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা ঐক্য গড়ে তুলবে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের আশাবাদ সত্যি হতে যাচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রোকেয়া রহমান, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া।
সিমেয়ন কের: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর উপসাগরীয় প্রতিনিধি।
সূত্র: প্রথম আলো