আমি সেই মিছিলটার প্রতীক্ষায় আছি
প্রকাশ : ২৮ মে ২০১৭, ২১:১৭
নারীবাদ বিষয়ে আমি একটু সাবধানী, এ নিয়ে লিখি না বললেই চলে। তবে এই সময়টাতে বাস করেও বাংলাদেশে নারীদেহ-বিদ্বেষের যে প্রকোপ, সেটা মাত্রাতিরিক্ত। সরকারি মদদে মৌলবাদের উত্থান সেই বিদ্বেষে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করছে, তাতে সন্দেহ নেই। এর রাশ টেনে ধরাটা এখন অতি-জরুরী। নারীবাদ বিষয়ক পুস্তক থেকে নয়, মনের গভীর থেকে উঠে আসা কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরবো।
যখন আমরা 'পশু' ছিলাম, বিবর্তনের অন্ধ গতিপথে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান আমাদের ভেতর ঢুকে গেছে। নিজের জিন ছড়িয়ে দেয়ার প্রচন্ড তাগিদ বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে জন্ম দিয়েছে নারী-অত্যাচার আর ধর্ষণের মতো কুশ্রী ব্যাপারগুলোর। সৌভাগ্যক্রমে পরিবেশের হস্তক্ষেপে 'মানুষ' সেসব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। এরপরেও উপাদানগুলো একেবারে মুছে যায় নি। প্রভাব আর প্রতিপত্তির জোরে এখনও সেইসব আচরণ আমাদের মাঝে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সমাজে এই প্রকাশ এখনও বাড়াবাড়ি রকমের প্রচণ্ড। পাশ্চাত্যের নারী জাগরণ সেসব সমাজের নারীদের যেসব সুযোগ সুবিধা তৈরী করে দিয়েছে, সেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে আমাদের নারীরা ভয়াবহ রকমের বঞ্চিত। তবে নারীরা চাইলে যে এই অন্ধকার থেকে উঠে আসতে পারেন, সে তো ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়।
একটা প্রচন্ড নাড়া দেয়া ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছে। মানুষ হিসেবে নারীর মৌলিক অধিকারগুলো বুঝার ক্ষমতা কেবল আমাদের পুরুষদের নয়, নারীদের মধ্যেও সীমিত। আমি জানি না এ-দেশের নারীসমাজ এই নাড়াটা দিতে পারবেন কী-না। না পারার কারণ বিবিধ। মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার সম্পর্কে, নিজের দেহ সম্পর্কে বাংলাদেশের ক'জন নারী জানেন ও বুঝেন, সেই স্ট্যাটিসটিক্স যদি প্রকাশিত হয়, তাহলে নারীবাদ নয়, মানববাদের জন্য সেটা ভয়াবহ দেখাবে। এই মুহুর্তে সেই নাড়াটা দেবার আয়োজন করতে হবে সেইসব সচেতন নারীদেরকে যারা ট্যাগভীত নন, অসম সাহসী, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, এবং মানববাদী। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এই নাড়া দেবার অনেকটা আয়োজন ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজন কেবল দল ভারী করে রাস্তায় নেমে আসার। আপনারা প্রতিটি বিভাগে, জেলায়, উপজেলায় সংগঠিত হোন।
এতো দিনেও রাস্তায় না নামতে পারার কারণগুলো একে একে চিহ্নিত করা এবং শোধরানো হোক। ট্যাগ খাবার ভয়ভীতি থেকে বেরিয়ে আসুন। 'শালীনতা' নামের কিম্ভুত শব্দটাকে লাথি মেরে বঙ্গোপসাগরে পাঠান। অব-পুরুষদের কপট চোখগুলোর উন্মুক্ত-নারীদেহ-সংবেদনশীলতা কমিয়ে আনুন। আপনাদের প্রতিবাদগুলোকে ঘরের জানালা ভেদ করে বাইরে বের করুন। এর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা নিন।
মাঝেমধ্যেই কিছু উটকো ভিডিও চোখে পড়ে যেখানে পুঁচকে ছেলেরা ওয়াজ-নসিহত করে। তাদের বিষয়টা মূলত নারীবক্ষকেন্দ্রিক। বাঙালি পুরুষদের নারীবক্ষপ্রীতি আর ভীতি, দু'টাই সর্বজনবিদিত। সাম্প্রতিক উদাহরণ নুসরাত ফারিয়ার ভিডিওটা। এই পুরুষগুলার বক্ষভীতি দূর না করতে পারলে আমাদের পক্ষে এগুনো সম্ভব না। এই বঙ্গে কবে থেকে এই বক্ষ-ফেটিশ আর বক্ষ-ভীতি চালু হয়েছে, তা আমার জানা নেই। ধর্মের সাথে এর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে, না-ও পারে। যদি থেকে থাকে, তবে সেটা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বলে মনে হয় না, কারণ প্রায় সব ধর্মই নারীকে 'বেশ্যা' ট্যাগ দিতে পারদর্শী। কথা হচ্ছে, এইসব আজেবাজে ভিডিওর বিপরীতে কোনো মেয়েকে কথা বলতে দেখি না। আরে ভাই, কথা না বললে, কানে প্রবেশ করবে কীভাবে? আর কানে না গেলে, সেটা মস্তিষ্কে প্রোথিত হবে না, এ-ই তো স্বাভাবিক। দয়া করে কথা বলুন। স্লাট, বিচ, বেশ্যা- এই ধরণের শব্দগুলোর বিপরীতে অন্য কিছু তৈরী করুন না! সেই সাহসটা কী নেই? আমি বিশ্বাস করি না যে নারীরা কোনওভাবে কম সাহসী।
প্রাণীদের পপুলেশনে ছেলে আর মেয়ের অনুপাত সমান, এর বিবর্তনীয় কারণ আর ব্যাখ্যাও রয়েছে। মানুষের পপুলেশনও এই প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে নেই। পৃথিবীতে যত পুরুষ আছে, বিপরীতে ঠিক ততজন নারীও আছেন। মানে, শক্তিতে নারী আর পুরুষ সমান। একটা সময় পুরুষেরা মনে করতো নারীদের কোনো শক্তি নেই, প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা নেই। সেই ভুল বিংশ শতকের গোড়াতেই ভেঙেছে। তেঁতুলতত্ত্ববাজরা বাংলাদেশে আজকে যে লম্ফঝম্ফ করছে, সেটা গুড়িয়ে দিতে নারীসর্বস্ব একটা বড় মিছিলের প্রয়োজন। রাস্তায় যখন ঢল নামবে, ধর্মবাজ পুরুষগুলোর চোয়াল এমনিতেই ঝুলে পড়বে। পালানোর পথ পাবে না।
আমি সেই মিছিলটার প্রতীক্ষায় আছি।
সালমান রহমান এর ফেসবুক থেকে