মেয়েদের এতো সাহস ভালো না !

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৭, ০১:১৬

অনন্যা নন্দী

আমার বাবা মারা যায় ২০০৭ সালে। তখন আমি মাত্র একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। তখন থেকে একা একা কলেজ যাওয়া, স্যারের বাসায় যাওয়া সবকিছুই করতাম। তখন কারো কোনো আপত্তি ছিল না। এইচএসসি'র পর টিউশনি করতাম। তিনটা টিউশনি করে প্রায় রাত ১০টায় বাড়ি ফিরতাম তখনও কারো কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি হলো তখন, যখন এক বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিলাম রয়েল হাট নামক রেস্তোরাঁয় ট্রিট নিতে। আমার এক আত্মীয় চোখ কপালে তুলে ফেললো। "এতো রাতে এখানে কী করছো!!" প্রশ্ন করল। উত্তর দিলাম, "আঙ্কেল, ফ্রেন্ডের জন্মদিন"। প্রত্যুত্তরে যা বললো, "শোন মেয়েদের এতো সাহস ভাল না। এত রাতে ঘুরাঘুরি না করে বাসায় যাও"। এভাবে দিন গড়াতে থাকলো আর আমারও ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরাঘুরি বাড়তে থাকলো। কারণ, আমার একটা যুক্তি ছিল, মেয়ে বলে কী আমার জীবনটা উপভোগ করার অধিকার নেই?

প্রতিবার বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা সাবধান করে দিতো যেন কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা হলে লুকিয়ে থাকি। এরপর যখন এলএলবি শেষ করে কোর্টে গেলাম তাতেও এই সমাজের আপত্তি। সবার জাস্ট একটাই কথা, "মেয়ে মানুষ এসব ক্রিমিনাল এর সাথে ডিল করতে যেও না। মেয়েদের এতো সাহস ভাল না। তার চাইতে মাস্টারি করো"।

আমি খুবই হতাশ হয়ে গেলাম। মেয়ে বলে কী আমি স্বাধীনভাবে কিছুই করতে পারবো না? আমি যা করি সবকিছুকেই দুঃসাহস হিসেবে ধরা হয় কেন? আমি যখন একা কলেজ যেতাম তখন তো কেউ প্রোটেক্ট করতে আসতো না। রাতে টিউশনি থেকে ফিরতে যখন ভয় লাগতো তখন তো কেউ আসত না। সবাই কেবল উপদেশ দিয়েই দায়িত্ব শেষ। সবচেয়ে বড় কথা হলো সবসময় একজন মেয়ে হিসেবে আমার সাহস বা স্বাধীন চলাফেরাকেই কেন দুঃসাহস বলা হবে? একজন ছেলেকে তো কখনই এসব বলা হয় না। একটা ২০/২১ বছরের ছেলে রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিলে সবাই বলে, "এটাই উপযুক্ত বয়স আড্ডা দেয়ার"। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে দুঃসাহস!!

খুবই অবাক হই এই সমাজের মানুষগুলোকে দেখলে। কারও কোনো দায়বদ্ধতা নেই মেয়েদের প্রতি। দুঃসাহস, বেলেল্লাপনা, নষ্টামি ইত্যাদি বিশেষণ কেবল মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ। দুঃখ লাগে যে এসব রক্ষণশীল (নামেমাত্র) পুরুষরা আবার বাসায় গিয়ে হেসে হেসে বউয়ের সাথে এসব বিষয়ে গল্পও করে!! আর বউরাও স্বামীদের সাথে হেসে কুটিকুটি হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশিরভাগ পুরুষই আবার কলিগ অথবা বান্ধবীকে সাহসী হতে বলে, তাদের সাহসিকতার প্রশংসাও করে। কেবল নিজের ঘরের মেয়েদের প্রতি তাদের স্পেশাল নিষেধাজ্ঞা। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে কিন্ত এদেশের মেয়েদের কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। নারী স্বাধীনতাকে এখনও এই দেশে 'দুঃসাহস' বলা হয়। এদেশের মেয়েরা যতক্ষণ সংসারের ঘানি টানবে ততক্ষণ তারা ভাল এবং ভদ্র। কিন্তু যখনই কেউ বন্ধুদের সাথে বাইরে বসে একটু আড্ডা দিতে চাইবে, ঘুরতে চাইবে, পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা পেশা বেছে নিতে চাইবে তখনই তা দুঃসাহস। এভাবে চলতে থাকলে বাঙালি মেয়েরা আর কখনও 'বেগম রোকেয়া' অথবা 'ইলা মিত্র' হতে পারবে না। কেবল দু'টাকা রোজগার করে হেঁশেল ঠেলেই জীবন শেষ হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত