রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজন নারীবাদী শিক্ষা
প্রকাশ : ০৪ মে ২০১৭, ১৯:২০
বাংলাদেশে কিছুদিন আগেই বাংলা তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে ‘রোকেয়া দিবস’ পালিত হলো। ফেসবুক নিউজ ফিডে অনেকের প্রতিক্রিয়া পড়ে জানতে পারলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেগম রোকেয়ার ছবির বদলে ‘বেগম’ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক নূরজাহান বেগমের ছবি দিয়ে ব্যানার করেছে।
বাংলাদেশের নারীরা বাংলাদেশের সমাজে জন্ম গ্রহণ করে, বেড়ে উঠে, দেশের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনা করবার পরও তারা আজও বেগম রোকেয়া, নূরজাহান বেগম, সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম, তসলিমা নাসরিন, সেলিনা হোসেন এর লেখা এবং তাদের নারীবাদী আদর্শের সাথে পরিচিত নয়।
দৈনন্দিন জীবনে নারীরা তাদের পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক জীবনে যে সকল শোষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয় সে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য নারীবাদী আদর্শ নারীদের চেতনা জাগানোর কাজ করে। নারীবাদ সমাজের লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণের জন্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে বলে সমাজে প্রতিবাদী নারীদের নিয়ে রয়েছে সমাজে নানা নেতিবাচক ভ্রান্ত ধারণা।
সমাজে সুশিক্ষিত পুরুষরাও নারীবাদী আদর্শের ধারক হতে পারে কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় কম হবার কারণে আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে কম।
আমাদের নারী অধিকারের অগ্রদূত যারা তাদেরকে অসচেতন বাঙ্গালী নারীরা জানে না। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীবাদীরা যে জ্ঞান-এর আলো নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, মুষ্টিমেয় সচেতন কিছু নারী ছাড়া তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ নারীই সেই জ্ঞানের আলো থেকে বহু দূরে বসবাস করে।
যে দেশের সরকারি দল এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী সে দেশেও ‘বাল্যবিবাহ আইন ২০১৬’ পাশ হবার পথে। এই আইন-এর যারা প্রণেতা ও অনুমোদনকারী, তারা যে নারীবাদী আদর্শ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বেগম রোকেয়ার আদর্শই লালন করেন না তা আজ স্পষ্ট। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন আজীবন অলীক স্বপ্নই হয়ে থাকবে।
উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বাংলাদেশের কয়টি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়? এই বিষয়টি নারী -পুরুষ উভয়ের জন্য একটি বাধ্যতামূলক বিষয় হওয়া উচিত সমাজে লিঙ্গ সমতা তৈরির লক্ষ্যে।
নারীর ক্ষমতায়নের কথা আমরা বলি কিন্তু নারীবাদী আদর্শ সম্পর্কে রয়েছে নেতিবাচক ধারণা, বিষয়টি নিয়ে জানতে চাই না, ইতিহাসের পাতায় নারীবাদী নারীদের নারী অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের গল্পকে তুলে আনছি না বা তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পর্যন্ত দিচ্ছিনা।
নারীদের প্রাপ্য অধিকার অর্জনে রক্ষণশীল পুরুষরাই সব সময় বাধা হিসেবে কাজ করে এসেছে, তাহলে নারীর উপর নির্যাতন, সহিংসতা তো বাড়বেই। বাংলাদেশের সমাজ এক উদ্ভট উটের পিঠে চড়ছে।
কানাডার মতো উন্নত দেশে যে সকল উচ্চশিক্ষিত বাঙ্গালী নারী অভিবাসী হয়ে আসেন তারা বেশিরভাগই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে আসেন, এখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকুরীও করেন। এইসকল উচ্চ শিক্ষিত অভিবাসী নারীও অধিকাংশই কানাডার মহীয়সী নারীদের চেনে না, তাঁদের জীবন আদর্শ ও কর্ম সম্পর্কে জানা তো দূরের কথা তাদের নামটি পর্যন্ত জানেন না।
ইন্টারনেট-এর যুগে এই সকল জ্ঞান বা তথ্য জানাটা দুরূহ কোন ব্যাপার নয়। আর এই দেশে প্রতিটি কমিউনিটিতে অনেক সুযোগ-সুবিধা সহ লাইব্রেরীও রয়েছে। তাদের সম্পর্কে জানবার আগ্রহটা অভিবাসী নারীদের মধ্যে নেই বললেই চলে।
প্রবাসী সচ্ছল বাঙ্গালী নারীদের নানা সামাজিক পটলাক ও বেবি শাওয়ার পার্টিতে মুখরোচক বাহারি রান্না করা খাবার আর সর্বাঙ্গে অলংকার, সাজপোশাকের অতিশয্যের মাঝে তাদের খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কমিউনিটির প্রাতিষ্ঠানিক এবং অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষামূলক কোন স্থানে তাদের উপস্থিতি শূন্যের কোঠায় বললে অত্যুক্তি হবে না।
নারীদের আত্ম জাগৃতি ঘটবে তেমন ধরণের উদ্যোগ (আমি কানাডার যে শহরে থাকি, সেই) সাস্কাটুনের প্রবাসী নারী মহল থেকে নেয়া হয়েছে বলে এখনও চোখে পড়েনি। প্রবাসী অভিবাসী বাঙ্গালী নারীদের সাজসজ্জা আর ভোগ বিলাসের প্রতিযোগিতা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকার সংস্কৃতি দেখে বেগম রোকেয়ার বিভিন্ন প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে যায়।
তাঁর চিন্তার একটি বড় বিষয় বা সমালোচনা ছিল নারীদের অধঃপতন তথা অবনতির জন্য নারী নিজেই দায়ী। তিনি তাঁর ‘বোরকা’ নামক প্রবন্ধে নারীদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন নারী তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অলঙ্কার ব্যবহারের জন্য অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু শিক্ষার জন্য করে না।
জ্ঞানগর্ভ একটি বই পড়লে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশটি ফ্যাশনেবল অলঙ্কার পড়লেও তার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না --- এই বক্তব্য বেগম রোকেয়া সেই একশো বছর আগে বলেছিলেন। কিন্তু অবস্থার খুব কি পরিবর্তন এসেছে?
এ যুগের নারীরা বড় বড় বই পড়ে শেষ করেছে আজ ডিগ্রী পাবার আশায় , চাকরি লাভের আশায়, ভালো চাকুরীজীবী স্বামী পাবার আশায়। এই সকল ব্যাপারে একটা বিশাল পরিবর্তনও এসেছে সমাজে, কিন্তু তাদের আত্মিক পরিবর্তন কতটুকু এসেছে, তারা কতটুকু স্বনির্ভর, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে তা এখনও প্রশ্ন সাপেক্ষ।
নারী অধিকার আদায়ের হিস্যা বুঝে নেবার লড়াইয়ে তাদের মানসিক সংযুক্ততা বা উপলব্ধি কতটুকু? আমাদের পূর্ব প্রজন্মের নারীরা যারা নারী অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলো বলেই আজ আমরা শিক্ষিত হতে পেরেছি , নারী স্বাধীনতা উপভোগ করতে পেরেছি, সে কথা আমরা কয়জন নারী অনুভব করি এবং সেই সকল মহীয়সী নারীদের সম্মাননা জানাই, অন্তরের অন্তঃস্থল হতে কৃতজ্ঞতা ভরে?
ইউনিভার্সিটি অফ সাস্কাচুয়ান ক্যাম্পাসে ডিফেনবেকার সেন্টারে চলছে কয়েক মাস ব্যাপী “সিস্টার’স ইউনাইটেড” নামে এক প্রদর্শনী, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কজন ছাত্র -ছাত্রী তার খবর রাখে? এই সাস্কাচুয়ান প্রদেশের নারীরা মাত্র একশত বছর আগে কেমন করে নারীদের ভোটের অধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছিল এবং কেমন করে তাঁরা সফল হয়েছিল আর কারাই বা সেই সকল মহীয়সী নারী, তাঁদের জীবন এবং কর্মকে তুলে ধরবার জন্যই এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে নারীর ভোটাধিকার অর্জনের ১০০ বছর পূর্তিতে।
কানাডার প্ৰেয়রি প্রদেশগুলোর মধ্যে ম্যানিটোবা এবং সাস্কাচুয়ান কানাডায় প্রথমবারের মতো ১৯১৬ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেয়। যে সমস্ত নারী ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন তাঁদেরকে বলা হয় “সাফ্রাজেটস্”। তাঁদের যুগান্তকারী কর্ম ও স্মৃতিকে স্মরণীয় করার জন্য এবং সর্বকালের সকল নারীবাদীদের উৎসাহিত করবার জন্য এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে।
এখানে শিক্ষনীয়ভাবে প্রধান সাতজন সাফ্রাজেট নারীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও তখনকার সময়ে রক্ষণশীল পুরুষরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কেন এবং কীভাবে নারীদের তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো সেই ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ভায়োলেট মাকনটেন ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান সাফ্রাজেটস্ নেত্রী যিনি আলবার্টা এবং ম্যানিটোবার সমমনা নারীদের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করেন। তিনি ছিলেন একজন কৃষক নারীবাদী। তিনি নারীদের ভোটাধিকার বোর্ড এর গোড়াপত্তন করেন। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়।
সাস্কাচুয়ান সাফ্রাজেটস্দের সম্পর্কে জানাটা জরুরি কারণ এই ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের হাত ধরেই পরবর্তীতে নারীর সমঅধিকারের আন্দোলন, নারীর সামাজিক জীবনের স্বাধীনতা, যে কোনো পেশায় যাবার অধিকার, শিক্ষার অধিকার এবং রাজনৈতিক ন্যায় বিচার অর্জনের পথগুলো প্রশস্ত হয়ে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে অভিবাসী নারীরাও আজ সকল কানাডিয়ান নাগরিক অধিকারগুলো উপভোগ করতে পারছে।
নারীবাদী আদর্শ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন শুধু নারীর প্রতি ন্যায় বিচারের জন্য নয়, প্রয়োজন একটি অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী সমাজের জন্য। মানবিকভাবে সহনশীলতাই পারবে সমাজে লিঙ্গ সমতা তৈরি করতে।
লেখক: গবেষক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, সাস্কাটুন, কানাডা
সূত্র: বিবিসি, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬