নারী নির্যাতন, সমাজের এক জ্বলন্ত ইস্যু
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫৬
দু'টি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমে যার কথা বলবো, তিনি হলেন পাপিয়া। শেষ রক্ষা হল না তার, তাকে হার মানতে হল। টানা দশদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে গেল ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যারাতে তাকে এ জগত ছেড়ে চলে যেতে হল। অসমের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরের বছর আটাশের গৃহবধু পাপিয়াকে যৌতুকের বলি হতে হল।
গেল ৪ এপ্রিল বদরপুরের সাহেব কলোনিতে শ্বশুরালয়ে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী জেলা শিলচর। সেখানে শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে। এবং সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। আর তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় শোক এবং তীব্র ক্ষোভের ছায়া নেমে আসে।
এখানে উল্লেখ্য যে, গেল ৪ এপ্রিল ভোরবেলা বদরপুর সাহেব কলোনির কোয়ার্টার নাম্বার এল ৩২ থেকে পাপিয়ার আর্ত চিৎকার শুনে পাড়াপড়শিরা জড়ো হন। সবাই মিলে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান। কিন্তু শাশুড়ি প্রণতি দে পাড়াপড়শিদের অপমান করে বলেন, তাদের পারিবারিক ব্যাপারে যেন কেউ নাক গলাতে না আসেন। পাপিয়ার চিৎকার এবং বাকি অন্য কিছু---সবকিছুই তাদের একান্ত পারিবারিক ব্যাপার। তবুও অনেকেই ধস্তাধস্তি করে ঘরে প্রবেশ করেন। কিন্তু ততক্ষণে পাপিয়ার শরীরের অধিকাংশই ঝলসে গেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তখন পাপিয়ার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে জাহির করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। পাপিয়ার ওপর অত্যাচারের চূড়ান্ত চাবুকটা মারা হয়ে গেছে। তার স্বামী সমরজিৎ দে ও ভাসুর অভিজিৎ দে তাকে শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে তাকে পৌঁছিয়েই তারা দু'জন কেটে পড়েন।
এদিকে, পাপিয়ার মৃত্যুর পর এলাকার মহিলারা এর বিচারের দাবী জানান। তারপর চাপে পড়ে পুলিশ পাপিয়ার শাশুড়িকে আটক করে। তার বর এবং ভাসুর তখনও পলাতক। কিন্তু ওইদিন বিকেলেই শিলচর আইএসবিটি থেকে তাদের দু'জনকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের বয়ান থেকে যা জানা যায়, তা হল, বছর তিনেক আগে পাপিয়ার সঙ্গে সমরজিতের বিয়ে হয়। তাদের এক শিশুপুত্রও রয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবি নিয়ে স্বামীগৃহে বিচ্ছিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় তাকে। কিছুদিন আগে তার বাপের বাড়ি থেকে এক লক্ষ টাকা নিয়ে আসার কথা বলে সমরজিৎ। এই সূত্র ধরে ঝগড়া-বিবাদের সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। এবং অবশেষে ৪ এপ্রিল ভোরে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর এই কাজে সমরজিৎকে সাহায্য করেন শাশুড়ি প্রণতি দে এবং ভাসুর অভিজিৎ দে। তদন্ত চলছে।
এবার চলে আসি দ্বিতীয় ঘটনা প্রসঙ্গে। করিমগঞ্জের নিলামবাজার এলাকার গৃহবধু রসিদা বেগমকেও এরকম বিয়ের এগারো মাসের মাথায় যৌতুকের বলি হতে হয়। পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। আর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। রসিদা বেগমের পিতা বদরুল হক এজাহারে অভিযোগ করে বলেন, রসিদার স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বশুরবাড়ির লোকজন অন্যায়ভাবে মোটা অংকের যৌতুক দাবি করে প্রায়ই তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতেন। যদিও প্রথমে রসিদা এ সব নির্যাতনের কথা কাউকে খুলে বলতেন না, কিন্তু পরবর্তীতে সব খুলে বলেন। এবং এরপর সাধ্যমতো শ্বশুরালয়ের লোকদের দাবি পূরণের চেষ্টা করেন বদরুল হক। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে, এবং অবশেষে তাকে পরিকল্পতিভাবে খুন করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৩ এপ্রিল সকালে রহস্যজনকভাবে করিমগঞ্জের নিলামবাজার থানাধীন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাবল গ্রামে গৃহবধু রসিদা বেগমের সাথে ঘটনাটি ঘটে। আর তার মৃত্যুর পর শাশুড়ি ফয়জুন নেছা ও স্বামীর ভগ্নিপতি খছরুল হক গা-ঢাকা দেন। আর তাই সন্দেহের মাত্রা অল্প বাড়ে। পুলিশ এ বিষয়ে ৬৮/১৭ নম্বরে মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে ধরতে সক্ষম হয়নি।
যে দু'টি ঘটনার কথা আমি এখানে উল্লেখ করেছি, দু'টিই এই সমাজের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ঘটনা। তাই এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে রাজি নন। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের দিকে আঙ্গুল তুলে, অনেক প্রশ্ন করে। সেদিন একজন খুব সুন্দর করে বলেছিলেন, কারোর বিয়েতে যখন আমাদের নেমন্তন্ন আসে, তখন আমরা দল বেঁধে সেখানে চলে যাই। অনেক হই হল্লা এবং মেয়ে দেখার পর খেতে বসে আমরা একে অপরকে বলি, মাছে নুন কম হয়েছে---মাংসটা কি দারুণ হয়েছে না!!--মেয়ের গায়ের রং দেখেছিস?--এত সুন্দর ছেলে!--না,মেয়েটার সঙ্গে ঠিক মানায়নি।--এই,মেয়ের গলার হারটা দেখেছিস?... কিন্তু কেউ আমরা ওঠে গিয়ে মেয়ের বাবাকে প্রশ্ন করি না, এতসব জিনিস আপনি কেন দিচ্ছেন? ছেলের বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করি না, এতসব জিনিস আপনি কেন নিচ্ছেন? মেয়ের বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করি না, এতসব জিনিস আপনি কোথা থেকে জোগাড় করেছেন, মেয়েকে কি আপনি বিক্রি করছেন? ছেলের বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করি না, আপনি কি এই ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন যে, মেয়ের বাবা এতসব জিনিস কিভাবে জোগাড় করেছেন? আপনি কি মেয়েকে ক্রয় করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন? মেয়ের বাবাকে আমরা প্রশ্ন করি না, আপনি কি জানেন না, পণপ্রথা আইনে নিষিদ্ধ? তবে কেন এটা দিতে যাচ্ছেন? ছেলের বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করি না, পণপ্রথা নিষিদ্ধ জেনেও কেন আপনি এসব নিচ্ছেন? আপনি কি আইনের চোখে অপরাধী নন? আর এই পণপ্রথা আইনিভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সমাজ থেকে এটা উঠছে না বলেই প্রত্যেক দিন আমরা আমাদের চোখের সামনে কত নারীকে এই পণের বলি হতে দেখছি। আর আমরাও এমন একটা জগতে বাস করি--শুনেও সেসব চোখ বুজে, কান বন্ধ করে পরনিন্দা-পরচর্চার সিলেবাসে ফেলে দিই।
সবশেষে আরও দু-চারটে কথা বলতে চাই। বিয়ে নামক যে প্রথা, যার জন্য কত নারীকে শূলে চড়তে হয়েছে, এবং আজও হচ্ছে, তা আমাদের কি দেয়--বিশেষ করে নারীদেরকেই? যে নারী নামক বস্তুটি নিজের বাপের বাড়িতেই পুরো মানুষ ছিল না, সে কিভাবে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পুরো মানুষ হবে? বিয়ের আগে সে থাকে মেয়েমানুষ---অমুকের মেয়ে, আর বিয়ের পর হয়ে যায় সে অমুকের স্ত্রী বা বউ। কক্ষনও কিন্তু তার নিজস্ব কোনো সত্ত্বা থাকে না। আর তাইতো রাজা রামমোহন রায় বলেছিলেন, 'মেয়েরা বিয়ের পর প্রধানত হল রাঁধুনি, শয্যাসঙ্গিনী এবং বিশ্বস্ত পরিচারিকা। এর চেয়ে বেশি কিছু না'।
জাগরণীয়ার ইমেইল থেকে