বলতে মানা-৪

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫৮

আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। 

আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।

বিঃ দ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান। 

সময় ১৯৯৩

রাবেয়ার গায়ের রঙ কাজল কালো, এত সুন্দর মুখশ্রি দেখতে প্রতিমার মত মনে হয়। তিনবোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় সে। এ গ্রামে সবাই তাদের ভিনদেশি বলে গণ্য করে। তার বাবা খুলনা থেকে কি কাজে কখন কক্সবাজারের কাছে এই গ্রামে এলেন জানা নেই। এই গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করে তাদের পৈত্রিক বাড়িতেই বসবাস করেছেন। তেমন কোন রোজগারপাতি না থাকলেও লোক ভালো ছিলেন তিনি। রাবেয়ার মা সাধারণ গ্রামের মেয়ে, সংসারে সবার মুখে তিনবেলা ভাত তুলে দিতে পারলেই সে সুখি। 

রাবেয়া এবং তার ভাইয়েরা বাবার কাছে গান শিখেছে, হাসিখুশি সাদামাটা গ্রাম্য জীবন তাদের। দশ বছর বয়সে সালোয়ার কামিজ পরছে সে, গ্রামের আর সব মেয়ের মত মাথার ওড়না কখনো পড়ে না তার। এত সুন্দর তার মুখশ্রী কিন্তু কাল বলে দু'চার কথা সবাই শুনিয়ে দেয়। কি করে এই কাল মেয়ের বিয়ে দিবে বাপ-মা কে জানে! বাপের যদি কিছু টাকা পয়সা থাকতো তাও কথা ছিল! 

এর মধ্যে এই দরিদ্র বাবা একদিন হার্ট ফেল করে মরেও গেল। মাত্র পনের বছর বয়সে পিতৃহারা রাবেয়া পাঁচ ভাইবোনের সবার বড়, সংসারের দায় তার কাঁধে। এই বছরই এস এস সি পাশ করল সে। কি করে আয় করবে ভেবে পায় না। গ্রামের সবাই পরামর্শ দিল কাছে উপশহরে ধনী একজন ব্যবসায়ী আছেন তার কাছে গেলে চাকরীর ব্যবস্থা হতে পারে। গ্রামের কলেজে পড়ালেখা চালিয়ে করা যায় এমনকিছু হয়তো পাওয়া যাবে। এক নামে চেনে সবাই এই ধনী আবুল হাসানকে, তার ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে এই গ্রামেরই স্কুলে, রাবেয়ার ছোট ভাইয়ের কাছে গান শিখে সে। 

মনে বিশ্বাস রেখে রাবেয়া একদিন গেল সেই আবুল হাসানের কাছে চাকরি চাইতে। সেদিন কি হয়েছিল, আদৌ কিছু হয়েছিল কিনা সঠিক কারো জানা নেই কিন্তু পুরো গ্রামে কে বা কারা রটনা রটিয়ে দিল আবুল হাসান রাবেয়াকে তার সাথে সহবাসে বাধ্য করেছেন এবং তার লোকেরা রাবেয়াকে সকালে গ্রামে ফেলে রেখে গেছে! এ ঘটনার কোন সাক্ষী নেই, রাবেয়া কোনদিন এই রটনার জন্য কারো কাছে বিচার চাইতে যায়নি। খুব কাছের প্রতিবেশীদের জানা ছিল এমন কোন ঘটনা বাস্তবে ঘটেনি। এই রটনার কারণে রাবেয়ার কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তার এবং তার দশ-বারো বছর বয়সি ছোট বোন দুজনের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। রাবেয়ার কোনদিন আর বিয়ে হয়নি। এই ঘটনার কোন রেশ আবুল হাসান, তার ছেলে কিংবা তার পরিবারে কখনো পড়েনি!!!

(চলবে...)

লেখক: গবেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত