এবার চলো মুখোমুখি দাঁড়াই
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৫৯
প্রিয়তমেষু,
তুমি যখন খুব ব্যস্ত রামনবমীর মিছিল, হনুমান জয়ন্তী, নবীদিবস, ওয়াজ মেহফিল নিয়ে, ঠিক তখন আমি তোমার পাশেই হেঁটে অফিস থেকে ফিরছি, আমাদের শহরের ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে। দেখোনি আমায়? দেখবেই বা কি করে, হাজারের বিপরীতে একা একজন মানুষকে চোখে পড়ার কথা নয়। যেভাবে একদিন তোমার নবী দিবসের উন্মাত্ততা দেখেছিলাম, সেভাবেই তোমার 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখলাম, বিহ্বল হয়ে। এবং ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই প্রতিবারের মতো তুমি প্রিয়তমেষু থেকে আমার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলে।
তোমাকেই লিখছি আজ। হয়তো তুমি আমার প্রেমিক, বন্ধু, সহকর্মী, সহপাঠী, পাশের বাড়ীর কেউ। কিন্তু ইদানীং এইগুলো পরিচয় থেকেও বেশী মুখ্য হয়ে উঠেছে তোমার উগ্র ধর্মীয় পরিচয়। আমি যত মানুষ হিসেবে তোমাকে সম্মান করতে চাই, ভালোবাসতে চাই, তুমি ততোবেশী সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উন্মাদনার চোরাবালিতে আটকে যেতে থাক। যতবার আমি তোমায় সমতার কথা বলি, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি, ততোবার তুমি উগ্র ধর্মান্ধ স্বরূপ নিয়ে তেড়ে আস আমার দিকে।
আজকে সারাদেশ জুড়ে উচ্চবর্ণ - নিম্নবর্ণ, ধনী-গরীবে, ধর্মে-ধর্মে, এতো বৈষম্য, এত ঘৃণা, এত হিংস্রতা, এত নিপীড়ন, নির্যাতন - আমি যখন এসবের প্রতিবাদ করি, তুমি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করো।যখন বলি রাষ্ট্রের যেরকম নিজস্ব কোনো ধর্মমত থাকবে না, রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ, রাষ্ট্রনেতাদের ও কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে না; তুমি বিরক্ত হও, রাগ কর। তোমার ঐ উগ্র ধর্মান্ধতার চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করলে তুমি আরো বেশী আক্রমনাত্বক হয়ে উঠো। অশ্লীল বাক্যবানে বিদ্ধ করো আমায়, খুনের হুমকি দাও, ধর্ষনের হুমকি দাও। আমার তখন মায়া হয় তোমার জন্য। সমতা, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তোমার ভয় দেখে, তোমার জন্য করুণা হয় আমার।
উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা প্রচারে তুমি একজন সাধারন মানুষকে তার জীবন জীবিকার আসল সমস্যা থেকে দুরে সরিয়ে দিতে চাও উগ্র হিন্দুত্ব আর উগ্র মুসলমানিত্বের জিগির তুলে। তার কানে কানে তুমি বলে দাও, 'গরব সে কহো হাম হিন্দু হ্যায়', 'জেহাদ করো, বিধর্মী মারো'। সাধারন মানুষ যাতে তার সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলো না চাইতে পারে তারজন্য প্রতিনিয়ত তাদেরকে তুমি উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির জালে জড়িয়ে ফেলতে চাও। আমি এবং আমাদেরও তুমি ঐ দলে টানতে চাও। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হও, তখন তোমার আস্ফালন আরো বেড়ে যায়। তুমি আমাকে, আমাদেরকে সেকু, মাকু, চীনের দালাল এসব হাস্যকর ছেলেমানুষী তকমায় ভুষিত করে দমিয়ে রাখতে চাও। দেশটাকে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি , এবং পাকিস্থানকে নিজেদের দাদুর সম্পত্তি ভেবে, তোমার বিরুদ্ধ মতের লোকদের পাকিস্থান চলে যাওয়ার ফতোয়া দাও। কারন, তুমি আমাকে, আমাদেরকে ভয় পাও। প্রচন্ড ভয় পাও। যদি আমি এবং আমাদের কথায়, একজন সাধারন মানুষও তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, তবে তো তোমাদের মিথ্যে ধার্মিক সাজার মুখোশ খুলে যাবে। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বার্থসিদ্ধির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনেক ছায়াযুদ্ধ হলো তোমার আমার। এবার চলো মুখোমুখি দাঁড়াই। উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে যতদিন তুমি মানুষকে পুড়িয়ে দিতে আসবে, মানুষ হয়েই তা প্রতিহত করবো আমি, আমরা। যত বেশী দমন পীড়ন করবে তুমি, ততোবার তোমাকে মানুষের শক্তি দেখাবো আমরা।
তোমার-আমার সম্পর্ক ভাঙবে, ভাঙুক। সব ভেঙ্গে চুরে ধ্বংস হয়ে নতুন করে গড়ে উঠুক সভ্যতা। যেখানে তুমি সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় উন্মাদনার চোরাবালি চিনতে পারবে, মানুষের সভ্যতা গড়তে শিখবে। সেদিন দেখা হবে আবার।
সুমনা চৌধুরীর ফেসবুক থেকে