ডাকার এই সুখ আর কোন ভাষায় পাই?
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০১৭, ০০:৫৩
আমরা জানি, বাংলাদেশের মত জনসংখ্যা বহুল একটা দেশে নাম রাখার মরশুম আসে ঘনঘন। সদ্যজাত শিশুকে ডাকার সুবিধার্থে রাখতে হয় নাম। গ্রিক শব্দ নামা, জার্মান শব্দ নামো, এবং ল্যাটিন শব্দ নোমেন থেকে জন্ম 'নাম' নামের নামটার। নাম একটা বিশেষ্য।
অথচ এই বিশেষ্য পদ বহনকারী জন্মানোর আগেই তার স্বজনদের খেয়াল থাকে তাকে নির্দিষ্ট একটা গোত্রে ফেলে দেবার। বিষয়টা এমন, শিশুর বোধ জন্মাবার আগেই তার বিশ্বাস নির্ধারণ করতে তৎপর সবাই!
বাচ্চদের নাম রাখা আমার প্রিয় কাজের একটি। এইজন্যই এই নাম রাখা নিয়ে নাজেহাল হতে হয় প্রায়। তবুও রাখি, রাখতে ইচ্ছে হয় এজন্য যে যখন ভাবি, একদিন এই বাচ্চা বড় হবে। বলে বেড়াবে কে তার নাম রেখেছে! আমি না থাকি, নামটাতো থাকবে! অপ্রিয় হলেও সত্য, প্রিয় কিছু প্রণয়ন করা সহজ কর্ম নয়। প্রিয় কিছুকে অনেক সময় জয় করতে হয় অপ্রিয় কিছুকে মাড়িয়েই।
এই যেমন; আমার ভাইয়ার প্রথম সন্তান। সঙ্গত কারনেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে ছিলো ও'। তো কান টানলে মাথা আসার মতো নামটা রাখা নিয়ে সবার মাথাব্যাথা শুরু হলো। নানা মুনির নানা মত। মুনিদের সবার মতামত তার একটা পূর্ব নির্ধারিত ধর্মের নাম লাগবে। অথচ সে পূর্ব নির্ধারিত ধর্মের ঘরটিতে জন্ম নিয়েছে নিতান্তই প্রকৃতির খেয়ালে।
সে খেয়াল কী আর কারো আছে! তবে খেয়াল করলাম নাম রাখা কার্যক্রমে আমার প্রাধান্য আছে। বাচ্চার ছোট বাজান (ফুফু) বলে কথা! রাতদিন বিভিন্ন ক্যালকুলেশন করে ঠিক করলাম ওর নাম রাখবো: প্রেম!
আমার ভাইয়া ভাবীর প্রেমের ফসলই তো সে! ওরে সর্বনাশ! এই নামের প্রস্তাব যখন পাড়লাম হয়ে গেলো লংক্কা কান্ড। ছি ছি ছি বাচ্চার নাম রাখবে প্রেম! অদ্ভুত। বিস্মিত আমি। এই সমাজে প্রেম যেন খারাপ বিষয়। প্রতিটা মানুষই তো প্রেমের উত্তেজনায় সৃষ্টি। মানুষভেদে হয়তো তা স্বল্পস্থায়ী, হয়তো তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিংবা অস্থায়ী কোনো সম্পর্কের পরিণতিতেও হয়। কিন্তু কিছু মুহুর্তের প্রেমময় আলিঙ্গনের সত্যরূপ হয়েই তো পৃথিবীতে আসি আমরা। (ধর্ষণ বাদে) তবু একে একে মুনিরা সবাই বেঁকে বসলো।
এরপর বলি, তাহলে ওর নাম হোক: সত্য!
হায় হায় কে জানতো এই সত্য নামটাও সমাজের এই বিভেদের মঞ্চে খারাপ লাগবে কারো! তার থেকেও বড় ভাবনার কথা এই নাম নাকি আরেক ধর্মের মানুষেরা বেশি বেশি রাখে। অবাক হলাম। নামের আবার ধর্ম! সত্য কার জন্য সত্য নয়?
তৃতীয় পছন্দ ছিলো: পবিত্র! অভিযোগ এলো, না না না। এই নামের পরিচিত অন্য ধর্মের ছেলে আছে। রাখা যাবে না। অসম্ভব। যুক্তি দিলাম আপনারাই তো বলেন, পবিত্র কোরআন শরীফ। পবিত্র এই সেই। তবে কেন এই নাম রাখবার জন্য পবিত্র নয়? এবার প্রস্তাব এলো। তাহলে শরীফ রাখো! এটা আরবী নাম। হ্যাঁ হয়তো শরীফ নামের বাংলা অর্থ ভালো। পছন্দ হলে কেউ তা রাখতেই পারে। কিন্তু বাংলা নাম রাখলে সেখানে আপত্তির হেতু কী?
বলি, আপত্তি জানানো মানুষগুলো আরবী ভাষাতেই নাম রাখবার মানদণ্ড অন্যের উপর চাপাতে চায় কোন যুক্তিতে? আরেকজনের পছন্দের নাম অপছন্দ করবার তারা কে? ধর্ম আরবী নাম রাখতে বলেছে? কিন্তু এই নাম রাখার ক্ষেত্রে গেলো গেলো ধর্ম গেলোরে.. বলা মানুষগুলো আরও গভীরে গিয়ে ভাবে না কেন যে, আরবী একটা ভাষা। বুঝে রাখলে ঠিক আছে কিন্তু একটা ভাষাতে সব ধরনের কথা আছে। গালিও আছে! তো না বুঝে সেটা রাখা কতটা অযৌক্তিক এই কথা বুঝে না কেন তারা!
বাচ্চার বাজানও কি আর কম ত্যাড়া! এতসব অপ্রিয় কথা মানুষ কেন যে ভাবে! এবার বললাম তবে ওর নাম হোক: প্রিয়! তাতেও নানা মত এলো তবু অনড় প্রিয়'র বাজান। অবশেষে প্রিয় নামটাই রাখলাম।
দেখতে ভালো লাগে, এই ছেলে বোধ হবার পর থেকে জানে ওর নাম প্রিয়। জানে ওর নামের অর্থ। সার্বক্ষণিক ওর আপন ভাবনায় থাকে ওকে প্রিয় কিছু করতে হবে। অপ্রিয় অসুন্দর কিছু করলে মানুষের অপ্রিয় হতে হয় যে! এই ভেবে কত কী করে সে। আপনি বসে আছেন ধুম করে এই ছোট মানুষটা আপনার কপালে চুমু দিয়ে আধো আধো বোলে বলবে, তমাল জন্য আদল! এটা কি তোমাল প্রিয়? স্কুল গিয়ে ওর প্রিয় সব পেন্সিল দিতে চেষ্টা করবে ওর প্রিয় কোনো বন্ধুকে। প্রিয়র পেন্সিলগুলো যে ওর বন্ধুর খুব প্রিয়! নামের কি দারুণ প্রভাব প্রতিফলিত হলো প্রিয়র মাঝে।
বলি কি, আমাদের ভাষা তো বাংলা। যে ভাষাতে আমরা অভ্যস্ত না, শিশুটা অভ্যস্ত না, ভিন্ন একটা ভাষা, জন্মের পরে কদাচিত সে ভাষা শুনে, সেই ভাষায় একটা নাম রাখতেই হবে এর যৌক্তিকতা তীব্র না। আমি বলছি না ভিন্ন ভাষা বা আরবী নাম রাখলেই সমস্যা। ইচ্ছে প্রবল হলে অর্থ জেনে কেউ তা রাখতেই পারে। কিন্তু অপরদিকে চিন্তা চেতনায় স্বাধীন একজন মানুষ তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলা নাম রাখলে আপনার সমস্যা হচ্ছে কোথায়? বাংলা আপনার ভাষা নয়? নামের আবার ধর্ম কেন নির্ধারণ করছেন? বাংলা ভাষায় কেউ নাম রাখলে আপনারই বা ক্ষতি কী? পেছনে কটুক্তি করছেন।
বাংলা ভাষায় শব্দের প্রাচুর্য কী কম? অর্থবহ নয়? নাতো!
পাননি আপনি? আমিতো পেয়েছি। এই প্রাচুর্যের সন্ধান পেয়েছি বলেই ভাবতে ভালো লাগে, এখনো কথা বলতে না পারা ছোট্ট প্রাচুর্য নিশ্চয়ই একদিন মানসিকতাতে প্রাচুর্যবান একজন হবে। যদিও নাম সবসময় পরবর্তী কর্মচারণ নির্ধারণ করে না।
তবুও তো বাংলা ভাষার সৌন্দর্য বুকে নিয়ে দেখি, নির্ঝরিণী মেয়েটার নাম। নির্ঝরিণী নামের মেয়েটা যেন নদীর মতই হৃদয়বতী। ডাকতেই জল ছলছল নদীর মতো সাড়া দেয়। উচ্ছ্বাস নামের কন্যাটি যখন তার উচ্ছ্বাস নামের বন্ধুকে নিয়ে একসাথে দৌঁড়ায় ভাবি, সমতা তো এই! জীবনের দৌড়ে এই সমাজে ছেলে মেয়ে কেউ বেশি কেউ কম নয়। ওদের দুই বন্ধুর দিকে তাকালেই ভাবি, নামের কোন লিঙ্গ আছে কী! পদ্মর চোখের দিকে তাকালেই দেখি, দীঘির বুকে ফুল। যেন আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলা ভাষা। অসহায় মানুষের প্রতি অপ্সরীর মানবতাবোধ দেখে ভাবি, কী আর খুঁজবো আমি? স্বর্গ তো এখানেই! ডাকার এই সুখ আর কোন ভাষায় পাবো? কোন অধ্যায়ে পাবো?
লেখক: প্রবাসী বাঙালি