ইনবক্স হ্যারাসমেন্ট
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০১৭, ১৮:৪৭
ইনবক্স হ্যারাসমেন্ট নিয়ে যে একের পর এক লিখে যাচ্ছি, এই তাড়নাটা আমার ভেতর থেকেই আসে। আমি সস্তা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বা আপনাদেরকে মজা দেয়ার জন্য এসব লিখি না। সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লিখি, কতটুকু কাজ হয় জানি না যদিও।
কিছুক্ষণ আগে আমাকে একজন একটা পোস্টের লিংক পাঠিয়েছেন যেখানে একটি মেয়ে একজন সেলিব্রেটির সাথে তার ইনবক্স কথোপকথনের স্ক্রিনশট পাবলিকলি শেয়ার করেছে। লোকটা ভিডিও কলে তাকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করেছে বলে মেয়েটা অভিযোগ করেছে। এটা ভাল, এ ধরণের সাহসিকতা অনেকের টনক নাড়াবে হয়তো। আমারও মাঝে মধ্যে একটা ভীষণ জেদ হয়, শিক্ষিত ভদ্রলোকদের একতরফা আলাপের ইনবক্স স্ক্রিনশট শেয়ার করে মুখোশ উন্মোচন করে দিতে। অনেকে অনুরোধ করেন এসব লোকের পরিচিতি সবার সামনে তুলে ধরতে। মজার আকাঙ্ক্ষাটা এখানেই কাজ করে। এসব স্ক্রিনশট দেখার মধ্যেও একধরণের সুড়সুড়ি আছে, যেটা আমি কাউকে দিতে চাই না। কয়েকজন দুষ্টু লোকের মুখোশ উন্মোচন করে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেও আমার মনে হয় না।
আমার প্রশ্ন হলো, একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে কেন রাত বিরাতে একজন সেলিব্রেটি হোক আর স্টার হোক, তার সাথে ইনবক্সে গল্প করবে, তার সাথে ভিডিও কল করবে? যে সমাজে নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবেই দেখা হয় এখনো, সেই সমাজে বড় হওয়া মেয়েগুলো কেন এসব পরিস্থিতি এড়ানো শিখছে না?
আমাদের জীবনে ফেসবুক এসেছে, ফেসবুক থাকবে, ফেসবুকের মাধ্যমে অনেক ভাল কাজ হবে, আবার অনেক খারাপ কাজের চেষ্টাও চলবে। এসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার শিক্ষা দিতে হবে আমাদের সন্তানদের, এবং নীতিবাক্য কপচিয়ে, বিধি নিষেধ আরোপ করে, অথবা বকাবকি করে এসব শেখানো যাবে না। আমার মতে সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ লেনদেনের মাধ্যমেই এটা সম্ভব।
একটা গল্প বলি। কয়েক বছর আগে আমার মেয়ের বয়স যখন চৌদ্দ/পনেরো, সে আমাকে বলল একজন মধ্যবয়েসী কবি তাকে বন্ধু অনুরোধ পাঠিয়েছেন এবং আমার অনেক বন্ধু ঐ লোকের লিস্টে আছেন দেখে সে তাকে এক্সেপ্ট করেছে। নামটা শুনে বেশ চমকে গেলাম। উনার দু'একটা কবিতা আমি পড়েছি, লেখেন ভাল, তাছাড়া তার পরিচিতি এবং দেমাকের মাত্রাটা এমন জায়গায় যে আমি নিজে কখনো তার বন্ধু তালিকায় ঢুকতে পারব বলে ভাবিনি। যা'ই হোক, একদিন মেয়ে আমাকে বলল ঐ কবি তার সাথে এতো বেশি কথা বলেন যে সে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। তিনি জীবন, সম্পর্ক, অনুভূতি এসব নিয়ে কথা বলেন, যদিও খুব খারাপ কোনো কথা নয় তবু তার সাথে উনার এতো বেশি কথা বলার চাহিদাকেই সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। আবার তাকে এড়িয়ে যাবার মত অভদ্রতাও দেখাতে পারছে না।
আমার খুব ইচ্ছে হলো মেয়েকে বলি, ‘ব্লক করে দাও’ কিন্তু যে মেয়ে মায়ের সাথে এতোটা শেয়ার করতে পারে, নিজে থেকে এধরণের যোগযোগের অস্বাভাবিকতা টের পায়, তার উপরে কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা থেকে কোনো মংগল আসতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমি শুধু বললাম, তোমার অনেক বুদ্ধি মা, বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নাও কী করবে।
এর মধ্যে আমি ঐ লোককে বন্ধু রিকোয়েস্ট পাঠালাম। ভাবলাম, যদি তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থেকে থাকে, আমার অনুরোধ পেয়ে তিনি সতর্ক হবেন। আর না থেকে থাকলে আমাকে বন্ধু বানাবেন, তখন তার সাথে আলাপ করে বিষয়টা স্পষ্ট করে নেয়া যাবে। তিনি আমার অনুরোধ যথারীতি এড়িয়ে গেলেন, এবং অন্যদিকে আমার মেয়ের সা্থে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকলেন। বিষয়টা নিজে থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি মেয়েকে এটা জানানোর পর সে তাকে ডিলিট করল, সিদ্ধান্তটা এলো মেয়ের কাছ থেকেই।
এতো লম্বা কাহিনী ফাঁদলাম এই কথাটাই বলার জন্য যে বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব থাকলে এসব সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান হয়ে যায়। আমি কখনো আমার মেয়ের সাথে ওই লোকের কথোপকথন দেখতে চাইনি, কিন্তু আমার এতোটুকু বিশ্বাস ছিল যে, আমাকে যতটুকু জানানো প্রয়োজন ততটুকু সে জানাবেই। আজ পর্যন্ত আমার যেসব বিদগ্ধ বন্ধুরা ঐ কবির স্তুতি গেয়ে তার কবিতা শেয়ার করেন তাদেরকেও আমি ঘটনাটা বলিনি। এখানেও তার নামটা বলবো না কারণ এটা আমার মেয়ের ব্যাপার। সে চাইলে নিজে বলবে, শেয়ার করবে। আমি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ঘটনাটা অব্জেক্টিভলি শেয়ার করতে পারি, তার বেশি নয়।
প্রতিদিনের ‘কেমন আছ, কী করছ’ নিয়ে পোস্ট দেয়া বাদ দিয়েছি কিন্তু আজ এতো কথা যখন বললামই আরেকটা গল্প বলে যাই। গতকাল নতুন সংযুক্ত হওয়া একজন মেসেজ পাঠালেন, ‘কেমন আছ তুমি? কি করছ’। ইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, একটা ছোটখাটো পত্রিকা এবং কোচিং সেন্টার চালান। বিনা বাক্যব্যয়ে ডিলিট করতে যেয়েও পারলাম না।
‘আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলছেন কেন? তাছাড়া একজন নারী কী করছে, তা জানতে চাওয়া কতটা অশোভন, তা আপনি জানেন না?’
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার মেয়ের বয়েসী, তুমি যে এত জ্ঞানী তা বুঝিনি।’
‘আপনার মেয়েকে বুঝি আপনি সে সারাক্ষণ কী করছে তা নিয়ে বাপের বয়েসী লোকদের সাথে ইনবক্সে গল্প করার উৎসাহ দেন?’
মূল কথা হচ্ছে আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে। ইনবক্স ভাই আর বাবাদের হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে হলে বুদ্ধি ব্যবহার করে চলতে হবে। মা-বাবাদের সন্তানদের সাথে এসব নিয়ে আরো খোলামেলা আলাপ করতে হবে। সবকিছুর পর আমরা নিজেকে যতটা নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন এবং পরিশোধন করতে পারি, অন্যকে চাইলেও তা পারি না। সবাই ভাল থাকুন।
জেসমিন চৌধুরী’র ফেসবুক থেকে
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক