খুঁজে ফিরি আলোক কণা-১
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০০:২৯
সেদিন কি বার ছিল আমার মনে নেই। (দিন তারিখের হিসেব আমি কোন কালেই রাখতে পারি না আমার তাই জন্মদিবস, ভালোবাসা দিবস, বন্ধু দিবস, বিয়ে দিবস, কোনটাই নেই; আর অদ্ভুত এক মিল আছে যে দিবসের ক্ষেত্রে সুমন (আমার কন্যার বাবা) তার স্মৃতি শক্তিও তাই! আমাদের তাই কোন দিবস ছিল না।
তখন আমি আমার ভেতরে আরেকটা অস্তিত্ব ধারণ করছি প্রায় আট মাস হয়ে গেছে, ডাক্তার আমার আল্ট্রাসনোগ্রাম করছেন মুখ খানিকটা থমথমে করে বললেন প্রথম সন্তান, জেন্ডার জানাটা কি জরুরী?
-জরুরী না, তবে সমস্যা নেই আপনি বলুন।
তিনি খুব সংকোচে বললেন আপনার মেয়ে হবে। যেন আমার গর্ভে মেয়ে হবার সমস্ত সংকোচ তার।
আনন্দে আমার চোখে জল চলে এলো। উনার সংকোচকে আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি ভীষণ গর্ববোধ করছিলাম স্রোতের বিপরীতে হাঁটবার জন্য আরেকজন মানুষকে পৃথিবীতে আনতে পারব বলে। আমার আনন্দ দেখে উনি আল্ট্রাসনোগ্রামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেকগুলো ছবি তুলে দিয়েছিলেন আমার কন্যার; বলেছিলেন, নিন পৃথিবীতে আসার আগেই আপনার মেয়ের দৃঢ়-সুন্দর মুখ দেখে নিন। কন্যার বাবা আনন্দে দুই হাত ছড়িয়ে চিৎকার করছিল আমাদের মেয়ে হবে আমাদের মেয়ে হবে বলে। রাস্তার লোকজন দুই পাগলের আনন্দভরা মুখ খুবই বিরক্তির সাথে দেখছিল! রিক্সাচালক বিস্মিত হয়ে বলেছিল, আপনেরা পাগল আছেন, মেয়ে অয়াতে এত আনন্দ কিয়ের!!! ওতো আর বংশের প্রদীপ জ্বালাইতে পারতো না!! আচ্ছা বংশের প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্বটা ছেলেদের হাতে কে দিয়েছে বলুন তো…?
আমি ভীষন খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে যাব ও আমার হাত ধরে বাকি পথটা নিয়ে যাবে। ওর বংশের প্রদীপ জ্বালাবার কোন দায় নেই ও মানবিকতার মশাল জ্বালবে যে মশালের আলোয় নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর হবে।
তারপর আমাদের সমস্ত স্বপ্ন কুঁড়ি হয়ে ফুটলো। সেটা শাহবাগ আন্দোলনের বছর, গণজাগরণের উত্তাল জোয়ারে পুরো দেশ ভাসছে, আমি কন্যাকে অস্তিত্বে নিয়ে টিভিতে, খবরে গণজাগরণের স্ফুলিঙ্গ স্পর্শ করি। সেদিন ২৬ ফেব্রুয়ারী আমার/আমাদের সমস্ত স্বপ্ন ধারণ করে ও পৃথিবীতে এলো, কন্যার বাবা ওর নাম রাখলো ‘আগুন ঝরা ফাগুন’। আমাদের একটা দিবস হলো কন্যার জন্মদিন, ২৬ ফেব্রুয়ারী; আমাদের স্বপ্ন কুঁড়ির পৃথিবীতে আগমন। আমাদের দিবসহীন জীবনে একটা দিবসের আবির্ভাব।
সেদিন ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারী সারা শরীর জুড়ে অস্বস্তি, আগের রাত থেকেই হালকা হালকা পানি ভাঙ্গছে; বিকেলে ডাক্তারের কাছে গেলাম তিনি ভর্তি হতে বললেন। ভয়, শঙ্কা আর উৎকন্ঠা নিয়ে গেলাম বাংলাদেশ মেডিকেলে এদিকে আমাদের হাতে কোন টাকা নেই। সুমনকে প্রশ্ন করলাম টাকার কি ব্যবস্থা হয়েছে? ও উত্তর দিল হয়ে যাবে চিন্তা করো না, অফিসে লোনের অ্যাপ্লিক্যাশন দিয়েছি, বলেছে প্রয়োজন হলেই পাওয়া যাবে। আমাকে প্রি অপারেটিভ রুমে নেওয়া হলো, প্রয়োজনীয় কিছু প্রক্রিয়া শেষে ডাক্তার পরীক্ষা করতে আসলেন তার সাথে আরো দু-তিন জন ইন্টার্ন ডাক্তার। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন বললেন রাতটা দেখবেন। আমরা যেহেতু নরমাল ডেলিভারি চাচ্ছি তাই তিনি অপেক্ষা করবেন। কথা শেষ করে তিনি একজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে বললেন পরীক্ষা করতে এবং কি অবস্থা বর্ণনা করতে- মেয়েটা হাতে গ্লাভস্ পড়ছে আমি ভালো করে লক্ষ্য করলাম, আৎকে উঠে বললাম না না আমি উনাকে পরীক্ষা করতে দেব না। ডাক্তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম, উনার হাতে এত বড় বড় নখ! উনি এই নখ নিয়ে পরীক্ষা করবেন কি করে? না আমি উনাকে পরীক্ষা করতে দেব না।
দেখুন এটা ওদের ক্লাস, পরীক্ষা না করলে ওরা শিখবে কি করে?
আমি আমার ক্ষতি করে উনাদের শিক্ষায় সাহায্য করতে পারি না। আর যে ডাক্তার এত বড় বড় নখ রাখেন তিনি অন্যকে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেবেন কি করে? ডাক্তার কিছুটা বিরক্ত হয়েই চলে গেলেন।
আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। তিন ঘন্টা হলো এখানে এসেছি সুমন বাইরে কি করছে কে জানে? কান্না পাচ্ছে, নিজেকে প্রাণপনে সামলাচ্ছি এমন সময় মা আর শাশুড়ী এলেন। মা রাতে থাকতে চাইলেন কিন্তু ভেতরে কারো থাকার সুযোগ নেই আর সারা রাত বাইরে থেকে কষ্ট করবার দরকার নেই সুমন তো আছেই, তাই অনেক বুঝিয়ে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। সারা দিন ধরে যে চাপা ব্যথা ছিল তা আস্তে আস্তে বাড়ছে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ব্যথাটা আসে আবার চলে যায়। একই সাথে শঙ্কা আর কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করছি সামনে কি হতে যাচ্ছে..!
ব্যাথাটার একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে আমি তা মনোযোগ দিয়ে অনুভব করছিলাম আর আমার অনাগত কন্যার সাথে কথা বলছিলাম। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। পাশের বেডের এক মহিলার কথায় ফিরে তাকালাম-
-আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন? কি হইছে?
মাথা নেড়ে বললাম কিছু না।
-বাচ্চার বয়স কত?
দশ মাস ১ দিন।
-তাহলে তো স্বাভাবিকই আছে। অন্য কোন সমস্যা নাই তো?
না।
-তাহলে কাঁদছেন কেন? আমাকে দেখেন -আমার বিভিন্ন রকম সমস্যা, বাচ্চার বয়স মাত্র ৭ এখনি সিজার করতে হবে, প্রচুর রক্ত লাগবে। আর আপনার বাচ্চার বয়স ঠিক আছে , কোন সমস্যা নাই, আর কাঁদবেন না।
আমি মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করলাম। সামান্য একটু কথায় আমি সারা জীবনের জন্য এই মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। আসলে এটা এমন এক সময় যখন মন থাকে ভয়ানক দুর্বল, সব সময় ভালো মন্দের দোলাচলে মন দোলতে থাকে। এই সময় একজন মা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজটি করেন, নতুন একটা প্রাণের সৃষ্টি! যতখানি আনন্দ ঠিক ততখানি ভয় কাজ করে আর যদি জীবনের প্রথমবার হয় তা হয় সবচেয়ে অজানা অচেনা আনন্দ-কষ্ট-ও ভয়ের সংমিশ্রণ! মন দোলতে থাকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে।
আমি জানি তখন সুমন (কন্যার বাবা) সেও অজানা অচেনা আনন্দ-কষ্ট-ও ভয়ের সংমিশ্রণে সময় পার করছে এবং ওর শঙ্কাও ভয় আরো বেশি! কারণ আমি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ও কিছুই বুঝতে পারছে না কি ঘটছে? কি হচ্ছে? ও শুধু অপেক্ষা করছে, এক অনন্ত অপেক্ষা শঙ্কা ও আনন্দের…।
(চলবে)
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী