প্লাস এর মহামারী থেকে রক্ষা পাক আমার বাচ্চারা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২১
একবার আমার জীবনেও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। আমার মেয়েটা তখন গ্রেড থ্রী থেকে ফোর এ উঠবে। স্কুলে বাচ্চাদের রিপোর্ট কার্ড আনতে গিয়ে দেখি, ওর রিপোর্ট কার্ড ওর বন্ধুদের হাতে পতাকার মতো করে উড়ছে আর সবাই সমানে সুবাইতা, সুবাইতা বলে চিৎকার করেছে। ঘটনা কি হইলো? না, সুবাইতা মানে, আমার কন্যা কেমনে জানি স্কুল ফার্স্ট হয়ে গেছে। বিশ্বাস করেন, কোন বিনয় না, এ ধরনের ভালো খবরের পরবর্তি এফেক্ট আমার কাছে দুর্ঘটনার মতোই লাগে। কারণটা বলছি। আমার ছেলেটি বরাবর একই রকম ফ্লাট রেজাল্ট করে, সব বিষয়ে মিনিমাম 'এ' পায়। মেয়ে বরং মাঝে মাঝে এ থেকে সি পর্যন্ত সব পায়। তো, সেই এ পাওয়া ছেলে আমার, বোনের এক্সট্রা অর্ডিনারি রেজাল্ট দেখে নিজেকে 'অকিঞ্চিত' মনে করতে শুরু করলো। এর পর আমাকে আমার পুত্রের কনফিডেন্স বিল্ডিং এ কাজ করতে হয়েছিল দীর্ঘদিন।
আমি নিশ্চিত, আজ যে বাচ্চারা বিশাল বিশাল প্লাস নিয়ে আনন্দ করছে তার পাশেই একটা বাচ্চা আর একটু কম কিছু নিয়েই নিজেকে 'অকিঞ্চিতকর' মনে করছে। এবং আমি জানি এই অকিঞ্চিত মনে করা বাচ্চারাই একদিন জীবনকে গড়ে নিয়ে এমন জায়গায় পৌঁছুবে যেখানে অনেক প্লাসই হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে, কারণ জীবনকে বিভিন্ন বয়সে উপভোগ করার মাধ্যমে যে জীবন দক্ষতা অর্জন করা যায়, সেই সময়গুলোই হারিয়ে যায় পরীক্ষা পাশের লেখা পড়ার চাপে। একটা গোল্ডেন 'এ' প্লাস, বা জিপিএ ফাইভ, বা 'ডিস্টিঙ্গুইশ' পাওয়াকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে বাচ্চা এবং বাচ্চার অভিভাবক সবাই মিলে একটা দীর্ঘস্থায়ী দুর্ঘটনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
আমার বাচ্চাদের সাথে আমার একটা ডীল আছে, তা হলো ওরা শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য টাইম ধরে লেখাপড়া করবে না। আমি তাদের পড়তে বসো পড়তে বসো বলে মাথা নষ্ট করবো না, কিন্তু আমাকে যেন কোনদিন কারো নামে অভিযোগ শোনার জন্য স্কুলে যেতে না হয়। তারা 'পড়াশুনা' করবে, এবং তা স্কুল কারিকুলামের ভিতরে ও বাইরে।
এটা একটু ঝঁকিপূর্ণ ছিলো, কিন্তু ওরা কথা রেখেছে। আমার কাজ কমে গেছে, আমাকে বাচ্চার স্কুলের বই আর 'ভাবী' র চাপ সামলাতে হয়নি। আমি আর একটা কাজ করি তা হলো স্কুলে রিপোর্ট আনতে গেলে আমি কখনো রিপোর্ট চেক করি না, তাদের দিয়ে করাই। কারটা ভালো হলো, কারটা কম ভালো হলো, কেন কম ভালো হলো সেটা তারা ভাইবোন নিজেরাই বুঝে নেয়। আমার কাজ হলো রিপোর্ট কার্ডে একটা কমেন্ট আর সাইন করা।
মেয়েকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি ওর কোন টিউশন লাগবে কি না, এটুকুতেই দায়িত্ব শেষ করি। মেয়ে শেষ চেষ্টা না করা পর্যন্ত টিউশন চায় না। ওর ছোট দুই ভাইয়ের টিউশন ও করে, এবং তার জন্য মাসে দুহাজার টাকা করে পায়। আমি আর একটু বেশী দিতে চেয়েছিলাম। ওই বলল, "মা, ওদের পড়া অনেক কম। তাই আমীমের পনেরশ' আর যামীমের পাঁচশ' দিলেই চলবে।
আমি আমার মাস্টার্স-এ প্রতি বিষয়ের পরীক্ষার আগের রাতেও যে কবিতা লিখেছি, আমি যে সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত কোনদিন সব বিষয়ে পাশ করে উপরের ক্লাসে উঠতে পারিনি, আরবী আর অঙ্কে ফেল করা আমার জন্য স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো, আমি যে আম্মাকে ফাঁকি দিয়ে পাড়ায় গিয়ে আড্ডা মারতাম সে গল্প আমি ওদের শোনাই। ওরা যখন খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মানুষ অঙ্কে কেমনে ফেল করে, আমি তার চেয়েও অবাক হয়ে ভাবি একটা বাচ্চা কেমনে অঙ্কে ফেল করবে না !!! জীবনের প্রথম প্রেম পত্রটিও আম্মাকেই এনে দিয়েছিলাম এই গল্পও আমি তাদের শোনাই। এবং ওরা যখন বলে আমি খুব বোকা ছিলাম, তখন আমি ওদের উলটো বলি, মাঝে মাঝে বোকা হওয়া ভালো।
আমার পেরেন্টিং নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। তা উঠুক। তবু আমি ওদের হাতে ধরে ফেল করা শেখাতে চাই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের বাচ্চারাই এতো বেশী কম্পিটিশন বুঝে ফেলসে, সেখানে বাচ্চাদের আর কুলোর বাতাস না দিলেও চলবে। বরং বাচ্চা বই এর নিচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়বে, মাঝে মাঝে ফেল করবে, স্কুল ফাঁকি দিবে, মাকে লুকিয়ে বন্ধুর বাসায় আড্ডা মারবে, তবেই না সে বাচ্চা। আমার বাচ্চারা বাচ্চা থাকুক, প্লাস-মাইনাসের মহামারী থেকে রক্ষা পাক।
যে মায়েরা, প্লাসের চাপে বাচ্চার মাথা নষ্ট করে ফেলছেন, তাদের বিনীত ভাবে একটা প্রশ্ন করি, আপনি কী প্লাস করে আজ এখানে এসেছেন? নিজের কোন এক্সাম্পল তৈরী করতে পেরেছেন কী বাচ্চার সামনে?
সাদিয়া নাসরিন এর ফেসবুক থেকে