সবিনয়ে নিবেদন
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:০৮
'শিল্পে বাঁচি শিল্প বাঁচাই' স্লোগান নিয়ে গত কিছুদিন ধরে শিল্পী-কুশলীদের লাগাতার আন্দোলন চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত পরশু দীপ্ত টিভি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হল। এ নিয়ে চলছে বাক বিতণ্ডা, কেউ কেউ দীপ্ত টিভি বন্ধেরও দাবি তুলেছেন এর কারণ দীপ্ত টিভির সুলতান সুলেমান আমাদের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন। এছাড়াও অন্য যেসব চ্যানেল বিদেশি ডাবকৃত সিরিয়াল প্রচার করছে তাদের বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন।
যারা যারা এই আন্দোলনের সাথে আছেন তারা সবাই আমার শ্রদ্ধাভাজন, অনেকে নমস্য, তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই কয়েকটা বিষয় নিয়ে জানতে চাইছি--
গত এক দশক ধরে আমাদের টেলিভিশনের দর্শক কমতে কমতে প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সেই দর্শক কিন্তু টেলিভিশন দেখা বন্ধ করেননি তারা রিমোট টিপে চলে গেছেন স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস এমনি সব ভারতীয় চ্যানেলে।
গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত আমাদের মা, শাশুড়ি, খালা, চাচী, বোন বন্ধুরা এবং তাদের ছেলে মেয়েরা সবাই মিলে এক সাথে সিরিয়াল দেখছেন, রাত ১২ টার পরে পুনঃপ্রচারের জন্য বসে থাকছেন। অফিসে আড্ডায় সিরিয়াল নিয়ে গল্প করছেন আর আমি যেহেতু আপডেটেড না তাই এদের সাথে কথা জমাতে পারিনি। আমার এমনও অভিজ্ঞতা আছে ঈদের অনুষ্ঠান পর্যন্ত দেখতে পারিনি বলে গ্রামের বাড়ির জন্য নিজেই একটা টিভি কিনতে বাধ্য হয়েছি।
এটা শুধু গ্রামে নয় শহুরে মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্ত সব পরিবারেই এক অবস্থা, এমনকি পুরুষদের অনেকেই এই সিরিয়ালে আসক্ত ছিলেন এখনও আছেন। পাখির জামা না কিনতে পেরে আত্মহত্যার ঘটনা খুব বেশিদিন আগের নয়।
অথচ এমন হবার কথা ছিল না, আমরা আমাদের ছোট বেলায় শুক্রবারের নাটক, মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক, ধারাবাহিক দেখার জুন্য মুখিয়ে থাকতাম, আমাদের নাটক নিয়ে গর্ব করতাম। সেই ইতিহাস উজ্জ্বল না হয়ে স্মিত হয়ে গেল কেন?
দায় কি শুধু ডাবিং সিরিয়ালের? বিদেশী আগ্রাসনের?
১। আমরা অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করলাম কারো অজান্তে টেলিভিশনগুলোর নীতিনির্ধারণী, গুনগত মান রক্ষার নিয়ন্ত্রক হিসেবে চেয়ারে বসলেন একজন আমলা, তথাকথিত সেলিব্রিটি, নিউজ প্রেজেন্টার অথবা মালিকের পছন্দ করা ব্যাক্তি।
২। টেলিভিশনের নাটক বা কমিশনিং অনুষ্ঠানগুলো চলে গেল এজেন্সি বা পণ্য ব্যবসায়ীর হাতে।
৩। একটা ২০ মিনিটের ধারাবাহিক নাটকে বিজ্ঞাপন চলে ১৫ মিনিট। মানুষ ভুলেই যায় সে নাটক না বিজ্ঞাপন দেখতে বসেছে। যদিও সেই নাটক স্রেফ ভাঁড়ামো বা ছ্যাবলামো বললেও কম বলা হবে। নাটক তার নাটকিয়তার বিন্দুমাত্র উপস্থাপন করতে পারে না।
৪। কোন গল্প নেই, কমেডির নামে যাচ্ছেতাই, ভাষার কোন আগা মাথা নেই। শয়ে শয়ে নাটক, নাট্যকার আর পরিচালকে দেশ ভরে গেল। অথচ একসময়ে যারা নিয়মিত নাটক বানাতেন, লিখতেন তারা বেকার হয়ে গেলেন। স্বজনপ্রীতি, সম্পর্ক প্রীতি, লেনদেন আরো অনেক কিছুর জন্য অনেকে এই পেশা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন এবং হচ্ছেন।
৫। বাজেট নিয়ে তো তুলকালাম কাণ্ড- আপনি যে স্ক্রিপ্টই দেন আপনার ১ ঘন্টার নাটকের বাজেট ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ বড়জোর, এর মধ্যেও আবার নানারকম প্রকাশিত, অপ্রকাশিত বিষয় আছে সেটা বলা উচিত হবে না।
৬। বাজেট যতই কম থাকুক আপনাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্টার আর্টিস্ট অবশ্যই নিতে হবে যাদের স্পন্সর ভ্যালু আছে (উল্লেখ্য এদের অভিনয় না জানলেও চলে) এরা আবার একেকজন একটা নাটকের অর্ধেকরও বেশী টাকা মজুরী নেবেন সেই সাথে শিডিউল ফাঁসাবেন, দিনের অর্ধেক সময়ের বেশী থাকতে পারবেন না, ব্যাক্তিগত নানা অজুহাতে এসব নিয়ে আপনি কথা বলতে পারবেন না কারণ এরা আছেন বলেই তো আপনার নাটক বিক্রি হবে!
৭। আমার জানা মতে ভারতীয় সিরিয়ালের অনুকরণে বাংলাদেশেও কিছু সিরিয়াল হচ্ছে কিন্তু তাদের বেশিরভাগ পরিচালক, কলাকুশলি ভারতীয় অখ্যাত অথচ বাজেটের দিক দিয়ে আমাদের ১০ গুণ বেশি পায়।
হ্যাঁ, আন্দোলন যদি করতেই হয় তবে এই অসম ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে করি না কেন? আমার হাতে ঢাল-তলোয়ার না দিয়ে আমাকে এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে না কেন?
আমি যদি বলি এক সুলতান সুলেমানের এক পর্বের বাজেট দিয়ে তো আমাদের দেশের পরিচালক ২০ পর্ব সিরিয়াল বানায় সেটা খুব বেশী বলা হবে?
আমি জানি যারা আন্দোলন করছেন তারা আমার চেয়েও এসব বিষয় অনেক ভালো জানেন কারণ তারা নিয়মিত কাজ করছেন আমি তা করতে পারি না। তারপরও এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা না বলে শুধু ডাবিং সিরিয়াল নিয়ে পড়ে আছেন কেন সেটা বুঝতে পারছি না বলেই এই লেখা।
ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ রইলো।
রওশন আরা নীপা'র ফেসবুক থেকে