উৎসবের কোনও লিঙ্গ হয় না!
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:৪৬
বাঙালির একটিই প্রাণের উৎসব, বলা যায় 'সবার উৎসব', যে উৎসব জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই মহা-আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করেন, তা হলো বাংলা বর্ষবরণ! পৃথিবীতে প্রচলিত বেশিরভাগ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনওভাবেই কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। তবু কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই উৎসব নিয়ে চক্রান্ত করছে। আমাদের সমাজে এই মানুষগুলো সব ক্ষেত্রেই ধর্মকে টেনে এনে 'শিরক ও বেদাতের' সন্ধান করে নতুন-নতুন ফতোয়া তৈরি করেন।
অথচ এই উৎসব নিতান্তই ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রাণের উৎসব। প্রধানত, কৃষিকাজ এবং রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়োজনেই এই বাংলা সনের সূচনা। পরবর্তী কালে যুক্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার রীতি-নীতি। দিনে দিনে এই বর্ষবরণ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব।
সেই বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালির একমাত্র বৈষম্যহীন উৎসব ছিল পহেলা বৈশাখ। সকালের রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা—এ যেন নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার এক মিলন মেলা। সবাই উৎসবের প্রতিটি ক্ষণে উপস্থিত থাকতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন, আয়োজনের মধ্যমনি হতে পারেন। এখানেই ছিল পহেলা বৈশাখের স্বাতন্ত্র্য, বাঙালি ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব।
যদিও গুটিকয়েক নির্লজ্জ, বেহায়াদের কাছে হার মানেনি কখনও এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবের উচ্ছ্বসিত আয়োজন, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার বছরের এই ঐতিহ্য, উৎসব, আনন্দ আয়োজনকে এভাবে নষ্ট করার চক্রান্ত কাদের?
জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধ কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের কাজ, এটা স্পষ্ট। এই অপশক্তির আরও অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করার। সেই ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালান এবং ঘটনাস্থলে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। নরহত্যাকে তারা তেমন কোনও গুরুতর পাপ বলে মনে করেন না! কপালে টিপ পরা থেকে শুরু করে পিচ-ঢালা পথে আলপনা আঁকা—সব কিছুই তাদের কাছে বিধর্মীয় আচার এবং তা দমন করতে তারা প্রতিবারই তৎপর হয়ে ওঠেন।
ভুলে গেলে চলবে না যে, '৭১ পুর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির নববর্ষ-উদযাপনকে নানান কায়দায় নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিল, বাধাও দিয়েছিল বিভিন্নভাবে। আজ আমাদের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে, তখনও একটি গোষ্ঠী একই কায়দায় নববর্ষ-উদযাপনকে বন্ধ করতে চাচ্ছে, কিন্তু কার ছত্রচ্ছায়ায়, তা খুব জানতে ইচ্ছে করে!
তাই নববর্ষের প্রাক্-কালে আনন্দে-শিহরিত মনে শঙ্কা জাগে,আমরা কি আগের মতো করে বলার সৎসাহস রাখি? এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার আনন্দ আয়োজন? আজ মনে প্রশ্ন জাগে, নারীরা কি আগের মতো করেই শঙ্কাহীনভাবে উৎসবে যেতে পারবে?
ধর্মীয় উৎসবগুলোয় লিঙ্গের বৈষম্যের জায়গা খুব পরিষ্কারভাবে টানা, এই বৈষম্য যতটা না ধর্মের, তার চেয়ে বেশি সমাজের। যেমন অনেক দেশেই এমন খোদ আমেরিকাতেও হাজারে হাজারে নারীকে দেখতাম ঈদের দিন মসজিদ এ যাচ্ছেন নামাজ আদায় করতে, কিন্তু ধর্মপাগল বাংলাদেশে তা কি সম্ভব? মসজিদ তো তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর। কয়টা মসজিদ আছে নারীর জন্য? পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশে নারীরা প্রবেশ করতে পারে এমন মসজিদের সংখ্যা হাতে গোনা। তারপর স্বামী মসজিদ থেকে ফিরলেই দিতে হবে সেমাই-কোরমা-পোলাও। সেগুলো তৈরি করবে কে? তাই রান্না চলে ভোরবেলা থেকেই। ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে এভাবেই নারীকে মুক্তি দেয় না সমাজ । 'ঘরের নারী'র বাইরের উৎসবে অর্থাৎ মসজিদ এ যাওয়ার সময় মেলে না।
নারী মসজিদ এ যায় না, নারী গরুর বাজারে যেতে পারে না, যা ঈদ উৎসবের সংস্কৃতি। নারীদের মধ্যে যাদের গরুর বাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তারা মাত্রই জানেন যে, কোরবানির গরুর মতোই 'দর্শনীয়' হয়ে ওঠেন নারী ক্রেতা। আর ভাই-এর মতো ঈদ এর রাতে পাড়ায়-পাড়ায় নারী বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ধর্মের কোনওটিকেই নিষেধ করেনি, কিংবা বলেনি, তুমি নারী, তাই 'ইহা করিতে পারিবে না'। কিন্তু মানুষের তৈরি সমাজ নিষেধ করেছে বহুবার বহুরূপে। ঠিক একইভাবে ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাদেশের প্রধানতম এই উৎসবকে ঘিরে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। আর বরাবরের মতো 'নারী'ই হয়ে ওঠে তাদের প্রধানতম টার্গেট। জানি না, গত বছরের পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসবে সংঘটিত নারকীয় ঘটনার সঙ্গে সেই একই শক্তি জড়িত কিনা, যারা যেকোনও মূল্যে অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবকে নস্যাৎ করতে চায়।
অবাক হয়ে যাই এটা ভেবে যে, সেদিন টিএসসি মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন, কিন্তু কেউ মেয়েদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি! পুলিশ তো সাধারণ নাগরিকের জন্যই কাজ করার কথা! কেন করল না? নারীদের ওপর এই বর্বর আচরণ ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীকে। অথচ দায়িত্বরত পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কোন দেশে বাস করছি! বছরের প্রথম দিন নারী লাঞ্ছনার ঘটনাকে সরকারের কোনও এক মন্ত্রী 'তেমন কোনও বিষয় না' বলে মন্তব্য করেছেন! এ থেকেই অনুমান করা যায়, বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কত দূর!
তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার এই চরম রূপ দেখে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের 'নাগরিক' হিসেবে যে দায়িত্ব, সেটা পালনে মনোযোগী হতে হবে। একজন নারীকে যখন কেউ কোনওভাবে হেয় করার চেষ্টা করবেন, তা শারীরিক কিংবা মানসিক—যেভাবেই হোক, খুব জোর গলায় তার প্রতিবাদ করতে হবে আমাদের। আর নারীর প্রতিবাদের সঙ্গে-সঙ্গেই আশেপাশের সবার এগিয়ে এসে ওই লম্পটকে ধরে ফেলতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই একটা গোষ্ঠীর মূল আক্রমণের জায়গা হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে ঘটে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা, সেদিকটাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
আমরা 'শিক্ষিত শহুরে নাগরিক'রা কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলে হবে না। আবার নারীদের ভেতরেও ছোটবেলা থেকেই একধরনের প্রতিবাদ না করার প্রবণতা তৈরি করে দেয় পরিবার এবং সমাজ, 'লোকে কী বলবে, কী ভাববে' এই ধরনের ডিসকোর্সের মাধ্যমে। এই ধরনের মনোভাবকে তোয়াক্কা না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, লাম্পট্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে পাল্টা ডিসকোর্স তৈরির মধ্য দিয়ে। বুঝিয়ে দিতে হবে, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র কেবল একা পুরুষের নয়, সমানভাবে নারীদেরও।
মনে প্রশ্ন জাগে, গতবছর পহেলা বৈশাখে এত মানুষের ভীড়ে যখন কিছু তরুণ বখাটেপনা করলেন, লিটন নন্দীর মতো করে যদি আরও ১০/১২ জন এগিয়ে আসতেন, তবে কি ওই লম্পটগুলোকে ধরে ফেলা যেত না? তাহলে অন্তত ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও, পুলিশ, তদন্ত ব্যুরো—রাষ্ট্রের এইসব উপকরণ (!) ব্যবহার না করেও আমরা ওই লম্পটদের শনাক্ত করতে পারতাম!
যেহেতু রাষ্ট্র তার পর্যাপ্ত উপকরণের অভাবে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সেহেতু এখন নির্যাতিতের 'নিজ'-এর কণ্ঠ উঁচু করতে হবে, প্রতিবাদ করার সব পদ্ধতি আত্মস্থ করতে হবে, এবং প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই 'সাধারণ' নাগরিকদের 'সক্রিয়' হয়ে উঠতে হবে, হয়ে উঠতে হবে 'অসাধারণ'।
সচেতন নাগরিক সমাজ আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সময় এসেছে নিজের দায়িত্ববোধের প্রতি প্রশ্ন করার। নিজের বিবেক বুদ্ধির কাছে হার মেনে যাওয়ার যে একটা 'অভ্যাস' তৈরি করেছি আমরা, তা থেকে বের হওয়ার সময় এসেছে। কতটা নিজের ভেতরে ঢুকে গেছি আমরা, কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছি যে, গ্যাসের আগুনে দগ্ধ একজন মা তার নিজের জন্য নয়, তার পুড়ে যাওয়া ৩ ছেলের জন্য একটা চাদর চেয়ে ৭ তলা থেকে নেমে এলেন, কিন্তু কেউ দরজা খুলে একটা চাদর দিলেন না! ধিক এ মানব জীবন! কী লাভ এই বেঁচে থাকার? এই ৭ তলা থেকে ১ তালা পর্যন্ত বাসিন্দারাই আবার ফেসবুকে বসে এই পরিবারের জন্য মায়াকান্না করে, প্রতিবাদ জানায়, আর চিত্কার করে ফেসবুকেব স্ট্যাটাস দেয়, সরকারের বিচারহীনতার, নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে বলে! এই আমরাই শিক্ষিত শহুরে নাগরিক, যারা এই কাজগুলো করছি প্রতিদিন, কিন্তু টের পাই না।
আমরা যে একটা 'নিষ্ক্রিয়তার' সংস্কৃতিতে ক্রমশই ঢুকে যাচ্ছি, সেটাও কি আমরা টের পাই? আমাদের সব ‘সক্রিয়তা’ অধিকাংশ সময়ই কেবল ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, টুইটার নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, তা কি আমরা খেয়াল করছি? প্রত্যেকটি নাগরিককে নিজের অবস্থান হতে আরও 'সক্রিয়' কিংবা 'দায়িত্ববোধ সম্পন্ন' হতে হবে যেকোনও ধরনের অরাজকতার বিরুদ্ধে।
হে নারী, প্রতিবাদী হয়ে ওঠুন, কণ্ঠস্বর তুলে ধরুন, 'নিষ্ক্রিয়তার' সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে 'সক্রিয়' হয়ে ওঠুন। মনে রাখতে হবে, অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে তারা ভয় পান, বিব্রত হন, এবং পালিয়ে যান। প্রতিবাদী কণ্ঠে জানান দিন, এই উৎসব সকলের—নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ-বৃদ্ধ প্রত্যেক নাগরিকের। কারণ উৎসবের কোনও লিঙ্গ হয় না।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[প্রথম প্রকাশ: বাংলাট্রিবিউন ১২ এপ্রিল ২০১৬]