সব নিয়ম শুধু মেয়েদের জন্যই?

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:২৩

নানজীবা খান

যতই বড় হচ্ছি ততই বিচিত্র দুনিয়ার নানার রকম জিনিস দেখার সুযোগ হচ্ছে। আজ মনে কিছুটা সাহস নিয়েই আমাদের শিক্ষিত মহলের মূর্খতার একটি কাহিনী লিখতে বসেছি।

আসল গল্পে আসা যাক। আমার একজন বান্ধবী আছে। একই সাথে আমরা স্কুল জীবন পার করেছি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ একদিন দেখলাম আমরা সবাই যখন ক্লাসে পড়া শুনছি, সে একটি কাগজের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। কয়েকদিন পর সে নিজেই বলল তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র ও নতুন সম্পর্কের কাহিনী। এই বয়সে এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এর পরিণতি সবসময় ভালো নাও হতে পারে।

এরপর থেকে নিয়মিত ক্লাসের পড়া করে আসা মেয়েটি পড়তেই ভুলে যেত, পরীক্ষায় মেধাস্থান দখল করা মেয়েটি ফেইল করল! তবে পড়তে ভুলে গেলেও প্রতিদিনের ঘটা রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলোর কথা আমাদের শোনাতে ভুলত না। আমারাও উপভোগ করতাম। না করার তো কিছু নাই! কারণ সময়টাতো এখন আমাদেরই তাই না? তবে সে হয়ত নিজের ভবিষ্যতের কথা ভুলে গিয়েছিল।

কোনো রকমে এসএসসি পরীক্ষা পাশ করল। অথচ শুরুর দিকে সবাই তার কাছে অনেক ভালো একটি ফলাফল আশা করেছিল। এরপরে যা হল তা আমরা প্রায়ই নাটক-সিনামায় দেখি। সবই এক, শুধু বাস্তবের পরিণতিটা রূপালী পর্দার সমাপ্তি থেকে।

যাই হোক, সে কলেজেও ভর্তি হলো। কিন্তু ক্লাসের নাম করে একদিন সেই ছেলেটির সাথে পালিয়ে গেল। পাঁচ মাস ১০ দিন পরে সে একাই ফিরে এল। তার বাব-মা জোর করে তাকে আরেক জন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। তখনও সে আমাদের মতই একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন। এই বয়সে মনের বিরুদ্ধে এমন একটি বিষয় মেনে নেওয়া তার জন্য কতটা বেদনাদায়ক ও মানসিক অশান্তির সেটা ওর পরিস্থিতিতে না পড়লে হয়ত বোঝা যাবে না।

এখন বলি তার মা-বাবার কথা। তারা নাকি মান সম্মান বাঁচাতে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। যে ছেলের সাথে ও পালিয়ে গিয়েছিল সে এখন  দিব্যি মা-বাবার কাছে আছে, পড়াশোনা করছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের অভিভাবক একদিন হয়তো নিজের ছেলের এই কর্মের কথা ভুলেই যাবেন। কারণ তারা তো ছেলের অভিভাভক। ছেলেরা নাকি এই বয়সে একটু এমন করেই! একদিন হয়তো সে অন্য কোনো একজনকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে।

আমার প্রশ্ন হলো এই একই কাজ আমার বান্ধবীর মা-বাবা করলে দোষ কী হতো? তারা ওকে বিয়ে না দিয়ে বোঝাতে পারতেন, নতুন করে জীবন গড়ার আশা দিতে পারতেন, আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করতে পারতেন।

নাকি মেয়ে বলেই শুধু সমাজে সম্মান রক্ষা করতে হবে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে? তাহলে কি সমাজের সব নিয়ম, সব লজ্জা শুধু মেয়েদের জন্যই? অবশ্যই কাজটি দোষের ছিল। তবে দোষ তো সে একা করেনি, তাহলে সেই ভুলের ভার সে একা বইবে কেন?

মানলাম যে ও অনেক বড় ভুল করেছে কিন্তু একজন শিক্ষিত অভিভাবক হিসেবে মেয়েকে সেই ভুলের নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে না বাঁচিয়ে আরও একটি ভুলের সাগরে ফেলে দেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হলো?

যদি একজন ছেলের অভিভাভাবক নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে, অতীত ভুলে গিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে পারেন, তাহলে একজন মেয়ের অভিভাবক হয়ে শুধু সমাজের লোক লজ্জার ভয়ে নিজেদের সন্তানকে পেছনের দিকে টেনে ধরা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

সেদিন ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছিস? ও বলল, "আল্লাহ যেমন রেখেছে।"

ওর এই কথাটা মাঝে মাঝে কানে বাজে।

কিছু হলেই দেখি আমাদের মা-বাবা সমাজের দোহাই দেন। সমাজ কি আপনার মেয়ের জীবনে সুখ আনবে? নাকি তার দুখের সময় তার পাশে থাকবে? কোনটা? সমাজ আমাদের সাথে বেশির ভাগ সময়ই থাকে না কিন্তু যখনই মেয়েরা কোনো ভালো কাজ কিংবা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যাই তখনই সমাজ অধিকাংশ সময় মেয়ে বলে তাচ্ছিল্য করে। এই সমাজটা কি শুধু ছেলেদের জন্য? নাকি মিলেমিশে একসাথে কাজ করে এই সমাজকে সুন্দর করাটা আমাদের দায়িত্ব?

মেয়েরা যখন হিমালয় জয় করা থেকে শুরু করে গোটা দেশ পরিচালনা করছে সেই একই যুগে দাঁড়িয়ে অকালে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হচ্ছে অগণিত সম্ভাবনাময় কিশোরীদের। আমরা শুধু দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের কথা নিয়ে ভাবছি, কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে অনেক শিক্ষিত মা-বাবাও এই পথ বেছে নিচ্ছেন। আর এই পরিসংখ্যান কম বলে আমরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না।

যে অভিভাবকদের নেই অর্থের বা অভাব  শিক্ষার অভাব, তারা কেন সন্তানের জীবন নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? নাকি তারা সমাজের ভয়ে ভীত? আমার আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কারণ আমি আমার বান্ধবীকে চোখের সামনে ঝরে যেতে দেখেছি।

সব মা-বাবাকে বলতে চাই, 'অনেক হয়েছে', এবার একটু থামুন। নিজের মেয়ে সন্তানকে শুধু মেয়ে হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবেও দেখুন!

সূত্র: হ্যালো, বিডিনিউজ২৪

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত