মীর জাফররা যুগে যুগেই জন্মায়
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৫৪
গত ৬ই নভেম্বর মহিমাগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জায়গা থেকে রক্তাক্ত কায়দায় উচ্ছেদ করা হয়েছে জায়গাটিতে বসবাসকারী সাঁওতাল এবং বাঙালীদের। এ উচ্ছেদে নেতৃত্ব দিয়েছেন এলাকার সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ এবং এলাকার চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল, সাথে এ রাষ্ট্রের নিপীড়ক বাহিনী পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি।
রংপুর চিনিকলটি লে অফ করা হয়েছে। সে জায়গাটিতে আদিবাসী ও বাঙালিরা বাড়ি ঘর বানিয়ে দখল রেখেছেলিন, সেটি সাহেবগঞ্জ – বাগদাফার্ম নামেই পরিচিত। সে জায়গাটিতে নানান রকমের ব্যবসা ফেঁদেছেন মিলের ব্যবস্থাপক আবদুল আউয়াল। নানান জনের কাছে জায়গাটি লিজ আউট করে টু পাইস কামাচ্ছিলেন।
চিনিকলটি লে অফ হয়ে যাবার ফলে এর জায়গা আদিবাসী ও বাঙালীদের কাছেই ফেরত দেবার কথা চুক্তি শর্ত অনুযায়ী। উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিকানার দাবিদাররা জমিটিতে হাজির হয়ে আন্দোলনে নামেন।
এই ভূমি উব্ধার আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে জড়িয়েছিলেন সাপমারা ইউনিয়নের ছাত্রলীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুল। ভূমি উব্ধার কমিটির সভাপতি হয়ে আন্দোলন সংগঠিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শাকিল আকন্দ বুলবুল। নিরীহ সাঁওতালদের কাঁধে পা দিয়ে জাতে উঠেই শাকিল ভোল পাল্টিয়েছেন। সরে গিয়েছেন আন্দোলন থেকে।
মীর জাফররা যুগে যুগেই জন্মায়। শাকিল উচ্ছেদ কার্যক্রমে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। আদিবাসী ও বাঙালী পল্লী উচ্ছেদ ও লুটপাটে তাঁর লোকজন জড়িত ছিল। আমরা সাহেবগঞ্জ – বাগদাফার্ম এলাকায় গেলে সবিস্তারে লুটপাটের বিবরণ দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
দ্বিজেন টুটুর গৃহবন্ধু বর্ণনা করছিলেন কিভাবে তাঁর চারটি ভেড়া ও দুটো গরু লুটে নিয়েছে হামলাকারীরা। তাঁদের গরু - বাছুর, ঘরের জমানো টাকা, হাঁস – মুরগী, ছাগল – ভেড়া, বাসনপত্র সবই লুটে নিয়েছে হামলাকারীরা, নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং একজন সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে!!
ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে পুলিশের উপস্থিতিতেই আদিবাসী ও বাঙালীদের বাড়িতে হামলা করা হচ্ছে এবং লুটপাট করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করেছে নিহত হয়েছে দুজন এবং আহত অনেকেই। আহত দ্বিজেন টুডু চক্ষু হারাতে বসেছেন। গুলিতে আহত লোকজনকে কোমরে দড়ি বেঁধে ও হাতকড়া লাগিয়ে পুলিশ হাসপাতেলে ভর্তি করেছে। এ নিয়ে রীট হলে আদালত দড়ি খুলে দেবার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ জারি হবার সাথে সাথে পুলিশ জোরপূর্বক হাসপাতাল থেকে গুলিবিব্ধ বিমল কিসকু ও স্বপন কিসকুকে রিলিজ নিয়ে রংপুর কারাগারে প্রেরণ করে এবং পরে লালমনিরহাট জেলে। আহত ভবিমল ও স্বপন কোন ঔষধ ও চিকিৎসা পায়নি পুলশী হেফাজতে ও কারাগারে। এ রাষ্ট্রের প্রশাসন ও পুলিশ নিরীহ জনগোষ্ঠীর উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে এমপির নির্দেশে।
আহত বিমল ও স্বপনের কাছে যখন চিকিৎসার কোন কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলাম তখন অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন বিমলের গৃহবন্ধু চিচিলিয়া বাস্কি। ঘরে কোন খাবার নাই একদিন আগে কিছু খেয়েছিলেন ভাগ্নির বাসায়, আর কিছু জুটেনি। চিকিৎসা কি দিয়ে হবে?
এ খাই খাই তন্ত্রের কর্ত্তাবাবুরা গুলি করে দিতে পারেন নিরীহদের কিন্তু কোন চিকিৎসা দিতে পারেন না!!
আহত অনেকেই পুলিশী ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না। তেমন একজন মংলী সরেন। ষাটোর্ধ একজন মহিলাকে ঘরে ঢুকে ঠেকিয়ে গুলি করেছে পুলিশ। তাঁর তিন ছেলে মেয়ে তাঁর সাথে থাকেন না। তাঁর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন তাঁর নীরব অশ্রুপাত বিবর্ণ করে দিয়েছে আমাদের। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে, পাছে তিনি আমাদের ক্রন্দন দেখেন।
সরকার ত্রাণ পাঠিয়েছিলেন ইউএনও মারফত, বসবাসকারীরা তা নেয়নি। কারণ এই ইউএনও গুলির নির্দেশদাতা বলে। ঢাকায় আদিবাসী নেতাদের সাথে ক্ষমতাসীন নেতারা মত বিনিময় করে ডিসিকে দিয়ে ত্রাণ পাঠিয়েছেন দেড়শো জনের মাত্র। আর কোন সরকারি ত্রাণ যায়নি। পুলিশ ও প্রশাসন এখন উচ্ছেদকৃতদের কাছে জাতীয় পরিচয় পত্র চাইছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে সমান করে ফেলা হয়েছে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবার সময়টুকু মেলেনি, সেই সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পরিচয় পত্র নিয়ে বেড়িয়ে যাবে ! আহাম্মক কোথাকার সব!!
অর্ধাহারে অনাহারে খোলা আকাশের নীচে বসে রয়েছে উচ্ছেদের শিকার জন মামুষগুলো। উত্তারাঞ্চলের এই শীতে অভুক্ত মানুষগুলো নিয়ে সমানে মিথ্যাচার করছেন জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপার এবং ইউএনও।
ডিসির বক্তব্য এ জমি সাঁওতাল বসবাসরত বাঙালীদের নয়, পুলিশের দাবি সাঁওতালরাই আগে হামলা করেছে, পুলিশ আহত হয়েছে। এখন জানা যাচ্ছে পুলিশের দিকে ধনুকের শর নিক্ষেপ করেছে শাকিলের লোকজনই।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের সামনেই সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেয়া হয়েছে। পুলিশ এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি, জানানোরও প্রয়োজন মনে করেনি। ইউএনও বলেছেন তিনি গুলি করার কোন আদেশ দেননি, অকুস্থলে কোন ম্যাজিষ্ট্রেটও ছিলো না। তাহলে গুলি করা আদেশ দিলো কে? এখন কর্তাভজায় মেতেছে এ পুলিশ।
সিধু কানুদের উত্তরসূরীরা আমাদের বলেছে একবেলা না খেয়ে থাকবে তবু জমির লড়াই ছাড়বে না।
যুগে যুগে শাকিল আকন্দ বুলবুল’এর মত মীর জাফররা এ বাঙালী সমাজেই জন্মায়।
এরা এখন এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ করছে, ভবিষ্যতে হয়তো হালুয়া রূটির জন্য অন্য দল করবে।
খাই খাই তন্ত্রের গণতন্ত্রে এমনটি ঘটে – খাওয়ারামদের কবলে বিমল কিসকু, মংলী সরেন ও রিয়াজুল মাষ্টারদের স্বদেশ!!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা