গণমাধ্যম যখন লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাবক
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:২৫
মুক্ত অর্থনীতির এই বাজারে সমাজ গঠনের পরোক্ষ প্রভাবক হিসেবে গণমাধ্যম যে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে- সে কথা এখন আর অজানা নেই। সে কারণেই নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপনের যে বৈষম্যমূলক ধারণা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বর্তমান, তাকে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন দৃশ্যায়ন। আর তাই নাটক, সিনেমা তো বটেই এখনকার দিনের বিজ্ঞাপনেও লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি উঠে আসছে প্রকটভাবে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপ্তি বিস্তার খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমানে অধিক সংখ্যক চ্যানেল, হাজার হাজার পণ্যের বিজ্ঞাপন, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে গণমাধ্যম সয়লাব। বিনোদনের নামে প্রায়শই খুব হীন এবং অসংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে নারী চরিত্রগুলো।
নাট্য অভিনেত্রী সারা যাকেরের মতে, সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণেই এখনকার বিজ্ঞাপন, নাটক ও সিনেমায় নারীর চরিত্রায়ণ এমন রূপ পেয়েছে।
তার ভাষ্যে, “বাংলাদেশ এবং এর সংস্কৃতি-মণ্ডল যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সবার মাঝেই একটা শেকল ভাঙ্গার প্রত্যয় ছিল। এই পরিবর্তন যে খুব ভালো কিছু ছিল তা নয়, তবে এখানে একটা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল।”
“তবে এখন এটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগ। এখানে সবাই ভোগ করে এবং ভোগে উৎসাহিত করে। এই ভোগ্য পণ্যের তালিকায় অনায়াসে চলে যাচ্ছে নারীও। হয়তো যে রীতিগুলো আমাদের মধ্যে ছিলও না সেগুলোও আমাদের মধ্যে চলে আসছে।” যোগ করেন তিনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল সুন্দর মানে চোখের বর্ণনা দেওয়া হতো, চুলের বর্ণনা দেওয়া হতো, তবে পুঁজিবাদ আমাদের শিখিয়েছে সুন্দর মানে ফর্সা। কারণ, নাহলে রং ফর্সাকারী ক্রিমের ব্যবসা হবে না!”
শুধু যে রূপ এবং সৌন্দর্যেই নারীকে বেঁধে ফেলা হচ্ছে তাই নয়। নারীকে হাস্যরসের উপাদান হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে এই সময়ের বিনোদনে। তাই প্রায়ই এমন নাটক বা বিজ্ঞাপন দেখা যায়, যেখানে স্বামীর সকালবেলার খবর পড়ার আয়েশ নষ্ট করে খুন্তি হাতে বাজারে যাওয়ার তাগাদা দিতে থাকা দজ্জাল বৌ! দুপুরের খাবারের চিন্তায় সারাদিন রান্নাঘরে অক্লান্ত শ্রম বিলিয়ে যাওয়া নারীটিকে উপস্থাপন করা হয় ‘বদরাগী স্ত্রী’ হিসেবে।
"আমরা ছেলেদের বলি না তোমাকে সবার সাথে মানিয়ে চলতে হবে, বরং মেয়েদের বলি, এমন কিছু করো না যেন লোকে তোমাকে মন্দ বলে। সেই এমন কিছুটাই হল নিজেকে প্রকাশ করা, নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা এবং নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকা।" ক্ষোভের সাথে বলেন সারা যাকের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ মিডিয়াতে নারীকে এভাবে উপস্থাপনের প্রভাবটা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, পুরুষের পৌরষ্যের দুটো ভাগ, এক. প্রভাব বিস্তারকারী, দুই. সহনশীল। পুরুষ যখন সহনশীল আচরণ করে সেটাও পৌরষেরই অংশ। সে যদি নারীর প্রতি সহনশীল হয় অথবা নারী সাহায্য করে, তার মানে এ নয়; সে নারীসুলভ আচরণ করছে। তবে আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে, পুরুষের সকল পৌরুষ্য প্রভাব বিস্তার করার মধ্যে। এতে যারা নারীর সঙ্গে মিলেমিশে এগুতে চায় তাদের স্ত্রৈণ, মেয়েলী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। বাস্তবে এটি একটি সামাজিক প্রচেষ্টা পুরুষকে সহনশীল অবস্থান থেকে প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থানে নেওয়ার, যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরাও স্বাভাবিক মনে করেন। এর প্রভাব জাতীয় পর্যায়ে পরিবেশিত সাময়িকী, নাটক, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপনেও এ চিত্র ফুটে ওঠে।
ড. ইমতিয়াজের কথার সমর্থন পাওয়া যায় শুধুমাত্র ঈদের সময় নির্মিত কিছু নাটক পর্যালোচনা করলে, অধিকাংশ নাটকেই নারীকে কিছু বিশেষ অবস্থানে দেখানো হয়েছে। ঘুরে ফিরে সব নাটকের উপজীব্যই নারী, প্রেম, কর্মজীবী নারীর সংসারের প্রতি অবহেলা, পুরুষের নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, পুরুষের ব্যভিচারী আচরণ এবং তার বিপরীতে নারীর শাশ্বত সতীত্ব। এমনকি হাসির নাটক বলে চালানো নাটকেও দেখাচ্ছে, নারী সকল সমস্যার মূলে, অথবা নারীকে পাওয়ার জন্য পুরুষদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, পরকীয়া অথবা স্ত্রীর ভূমিকারে অস্বীকার করা। মিষ্টি প্রেমের গল্পে ভালোবাসার নামে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুরুষের নিয়ন্ত্রনকামীতা।
এ তো গেলো নাটক ও বিজ্ঞাপনের বিষয়। বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীর অবস্থান আরও খারাপ। সেখানে দৃশ্য এবং গানের মাধ্যমেই মোটা দাগে নারীকে অবলা, কুমন্ত্রনাদানকারীর পরিচয় দেওয়া হয়, প্রেমের প্রস্তাব মানে নায়কের নায়িকাকে উত্যক্ত করা; তা দেখে নায়িকার প্রেমে পরে যাওয়া, রগরগে ধর্ষণের দৃশ্য, বহুগামিতাকে প্রশ্রয় ইত্যাদির সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ভারতের অনুকরণে ‘আইটেম নাম্বার’ যেখানে একজন নারীই নিজেকে যৌন পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে।
দৃশ্যায়ন মানুষের মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। অনেক কথা যা বলে মানুষকে শেখানো সম্ভব না তা দেখানোর মাধ্যমে শিখিয়ে দেওয়া যায় সহজেই, মত দেন সারা যাকের।
ড. ইমতিয়াজের মতে এই ধরণের সমস্যার মূল আরও গভীর। প্রথমত, আমাদের দেশে কখন কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে, তখন দর্শক যারা থাকবে তাদের বয়স কেমন হবে, অথবা কত বছর বয়সী মানুষের এই অনুষ্ঠান দেখতে পারবে এ ধরণের কোনো মান নেই। এমনকি কোনো মাধ্যমেই কোনো অনুষ্ঠানের ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়েও তেমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে না। তার উপরে শিশুদের বিভিন্ন মাধ্যমে এমনভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে যেন তারা একজন বড় মানুষই। ফলে শিশুকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করে বিষয়গুলো সরাসরি শিশুদের মাথায় ভরে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ এখনও শিক্ষা গ্রহণ এবং ধারণ করে না। ফলে এইসব বিনোদনকেই তারা জীবনের আদর্শ বলে ধরে নেয় সহসাই। যোগ করেন ড. ইমতিয়াজ।
সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৪২টি, এর মধ্যে ১০৭ জনের বয়স ৭-১২ বছরের মধ্যে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের এক জরিপে পুরুষদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন কি না। এর উত্তরে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সব ধরনের বেশির ভাগ পুরুষই জানান, তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন। অর্থাৎ এখানে নারীদের নিয়ে পুরুষদের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পুলিশের বার্ষিক অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র ২০১৫ সালে যত অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে ১১.৭৮% নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। এখানে আরও উল্লেখ্য যে অনেক অপরাধই কখনও নথিভুক্ত হয় না। ব্যাকের ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চলা একটি গবেষণা অনুযায়ী, নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। নথিভুক্ত হলে সংখ্যাটি আরও বাড়ত।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বসাকুল্যে ২০১৫ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে ৩৫% বেড়েছে। যৌন হয়রানি ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে ১৮৪৭ নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং সহিংসতার শিকার হয়ে ৩০১ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। বাড়ছে এসব কাজে কিশোরদের সংপৃক্ততাও। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসব নারী নির্যাতন মামলার আসামীদের ৫৩ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম।
সম্প্রতি জব্দ হওয়া ফেইসবুক গ্রুপ “ডেসপারেটলি সিকিং আনসেনসরড”-এর গ্রেফাতারকৃত ৩ এ্যাডোমিনের বয়সও ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে। এ গ্রুপটির বিরূদ্ধেও পর্নোগ্রাফি ধারণ এবং ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
“এসব অপরাধ বা অবমাননাকর পরিস্থিতি তৈরি করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।” বলেন ড. ইমতিয়াজ।
সারা যাকের মনে করেন, খুব সহজেই এইসব সমস্যার সমাধান আসবে না। কেননা শুধু বিজ্ঞাপন চিত্র না, বর্তমানকালে পণ্যের প্রচারের জন্য, পণ্য বিপনন বিভাগ নাটক বা চলচ্চিত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে নারীর প্রতি এ ধরণের আচরণ খুব রাতারাতি বদলে যাওয়া সম্ভব নয়।
এসব আচরণের বিরুদ্ধে বিপরীতমুখী কিছু প্রচার করাও সহজ নয়, কেননা একটা পণ্যের বিজ্ঞাপনে যত অর্থ ব্যয় করা হয় সামাজিক সচেতনতার পিছনের তা কখনও হয় না। ফলে দুপক্ষের যুদ্ধ কখনও সমানে-সমান হওয়া সম্ভব না। ব্যাখ্যা করেন তিনি।
সারা যাকেরের মতে, এ বিষয়ে গবেষণা, আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক চলমান থাকা উচিৎ। এতে যেমন একটা সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হবে, তেমনি কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এটিই হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান।
সূত্র: বিডিনিউজ২৪