তসলিমা নাসরিনের ‘পর্নোগ্রাফি’ ভাবনা
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ০১:৩৯
ইন্টারনেটে ভালো মন্দ নানা কিছু পাওয়া যায়। সত্য অসত্য, ধর্ম অধর্ম সব। বিস্তর সেক্সও। তথ্য খেতে পারো, মিউজিক খেতে পারো, সেক্স খাবে না কেন? খাবে না মানে? সেক্সের মতো সুস্বাদু খাদ্য আর কী আছে? সেক্স খাওয়ানোর এবং খাওয়ার লোকের অভাব নেই জালের জগতে। কিন্তু সেদিন তো আমি হাঁ হয়ে বসে রইলাম, ভারতের অবাঙালি ছেলেরা তো বটেই, বাঙালি ছেলেরাও বউএর সঙ্গে নিজেদের হার্ডকোর যৌনতার ভিডিও জালের জগতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পাঠিয়ে দিচ্ছে মানে বিক্রি করছে। সেসব ভিডিও দেখলে যে কোনও অন্ধও বুঝতে পারবে যে বউ কি জানে না ভিডিও কী কারণে করা হয়েছে। বউ যদি জানতে চায়, শান্ত-সুবোধ-চমশা পরা ভালো ছাত্র-ভালো চাকুরে-বর বলে, ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য। ব্যক্তিগত সংগ্রহটি যে দুদিন পর আপামরজনতার সংগ্রহের বস্তু হয়ে উঠেছে, তা বর জানলেও বউটি জানে না। বরের নির্দেশ সে লক্ষ্মী বউএর মতো পালন করছে। কারণ, বর বলে কথা। শাস্ত্রে আছে, ভগবানের আদেশও অমান্য করে সত্যমিথ্যে বলে পার পাওয়া যায়, কিন্তু বরের আদেশ না মানলে নির্ঘাত নরক। লজ্জা একটু একটু করে দূর করতেই হয় বউকে, বর ছাড়া ঘরে তো আর কেউ নেই। কিন্তু বউ-বেচারা লক্ষ্য করে, বরের ব্যবহার আজ মোটেও স্বাভাবিক নয়। বর তার নিজের বড় ছোট সব অঙ্গকেই চর্বচোর্ষলেহ্যপেয় হিসেবে বিবেচনা করতে বউকে আদেশ দিয়ে দিয়েছে। ক্যামেরাকে এমনভাবে বসিয়েছে যেন বিছানায় শুয়ে থাকা বউএর অলিগলিতস্যগলি অবধি দেখা যায়। এরপর বউটির শরীর আঁচড়ে কামড়ে যেমন ইচ্ছে ভোগ করে বর। চৌষট্টি কলার শিল্প জগতসুদ্ধ বিখ্যাত হলেও বেশির ভাগ বাঙালি এক কলাতেই তৃপ্ত। যৌনশিল্পে পারদর্শীদের ভিডিওর কাতারে এখন এই শিল্পে অল্পবিদ্যে অল্পজ্ঞান সম্বলিত প্রায় অনভিজ্ঞ বাঙালির ভিডিও রীতিমত এঙ্ােটিক। লজ্জা, দ্বিধা, সংকোচ মিঙ্ড। খাবে না মানে লোকে? উপুড় হয়ে পড়ছে।
আমার প্রশ্ন, ওই পতিব্রতা মেয়েরা কি কোনওদিন টের পাবে তাদের পতিদেবতারা কী ভয়ংকর অন্যায় কাজ করছে! শুধু বউদের ক্রীতদাসী বানিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, যৌনদাসী বানিয়েও শান্ত হচ্ছে না, পর্নোগ্রাফির ব্যবসা করছে তলে তলে? বিকৃত রুচির কথা বাদই দিলাম, আইন বিরোধী এই অপরাধটি করে স্বামী নামক ক্রিমিনালগুলো কী করে পার পাচ্ছে! এই প্রশ্নটা পাড়ার লাট্টুও শুনলে বলবে যে বোকার মতো করেছি! পার তো পুরুষেরা চিরকালই পেয়ে যাচ্ছে, ক্রাইম করে পার না পাওয়ার যে ৪৯৮ রয়েছে, সেটাকেই এখন শুনি চোখ রাঙাচ্ছে, নির্দোষরা ফেঁসে যাচ্ছে বলে চারদিকে এখন সদলবলে ‘মানি না, মানবো না’ হুমকি। ৪৯৮ ছাড়া যত আইন আছে দেশে, ওসবে বুঝি নির্দোষদের ফাঁসানো হয় না? শুধু ৪৯৮এ (নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইন) ফাঁসলেই এর বিরুদ্ধে খিস্তি করতে হবে! আসলে চুলচোখ মুখ বুকপেট তলপেট সর্বস্ব পণ্যের পক্ষে আইনের কড়াকড়ি দেখলে পুরুষদের বড় গা জ্বলে!
বাঙালির সেক্স ভিডিও দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, যে মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তারা ইচ্ছে করলে কি পারে না লোরেনা ববিট হতে? লিন্ডা বোরম্যান হতে? আমেরিকার মেয়ে লিন্ডা বোরম্যানকে দিয়ে জোর করে তার স্বামী পর্নো ছবি করাতো। মেরে ধরে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে, কাপড় খোলাতো আর সেক্স করাতো, সেসবের ভিডিও বিক্রি করতো বাইরে। মৃত্যুভয়ে স্বামীর নির্দেশ মানতে বাধ্য হতো লিন্ডা। কিন্তু ভয় ডর বিদেয় করে একদিন সে রুখে দাঁড়ালো। আইনের দ্বারস্থ হলো, স্বামীকে ডিভোর্স দিল। পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিন্ডা বোরম্যান এখন বিখ্যাত এক নাম। আশির দশকে বোরম্যান-মামলা পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাষ্ট্রে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইন পাস করিয়েছে। পর্নোগ্রাপিকে নিষিদ্ধ করার জন্য আইনের লড়াই চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথরিন ম্যাককিনন। তিনি কিন্তু বলেননি পর্নোগ্রাফি অশ্লীল জিনিস, অসভ্য জিনিস, সুতরাং নিষিদ্ধ করো। তাঁর কথা, পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এতে মেয়েদের বিরুদ্ধে সেক্স ডিসক্রিমিনেশন বা লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন শুধু নয়, মেয়েদের নাগরিক অধিকারও লঙ্ঘন হচ্ছে। প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর তিন আগে ক্যাথরিন ম্যাককিননের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো। পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই কেমন চলছে জানতে চাইলে বললেন, তাঁকে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নারী বিরোধী পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার জন্য লড়তে হচ্ছে এবং এ লড়াই বড় কঠিন লড়াই। পণ্য নিয়ে পর্নো করার সুবিধেয় কেউ বাদ সাধলে, পর্নো ব্যবসায়ীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছে, রক্ষে নেই। তাঁকেও তাঁর নিজের দেশে চলতে ফিরতে নিরাপত্তা রক্ষীর সাহায্য নিতে হয়।
লোরেনা ববিটকে মনে আছে? যে মেয়ে স্বামীর অত্যাচারে প্রতিদিন অতিষ্ঠ হতে হতে এক সময় প্রতিবাদ করেছিলো! তার প্রতিবাদের ধরনটা একটু ভিন্ন রকম। একরাতে ঘুমন্ত স্বামীর পুরুষাঙ্গ ধারালো ছুরিতে ঘচাং করে কেটে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল লোরেনা। এক হাতে তার ছুরি, আরেক হাতে কাটা পুরুষাঙ্গ, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছিলো বলে ওটাকে জানালার কাচ নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কোনও এক গমক্ষেতে বা আলুক্ষেতে গিয়ে পড়লো সেই অঙ্গ। খানিক পরে লোরেনা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলো কী কাণ্ড সে করেছে। ঘটনা জানার পর তাড়াতাড়ি করে ক্ষেতে ছুঁড়ে ফেলা ওই অঙ্গ খুঁজে এনে বরফে ডুবিয়ে রেখে উরুসন্ধিতে জোড়া লাগিয়ে জন ববিটের পুরুষত্ব কায়ক্লেশে রক্ষা করেছিলো তার বন্ধুরা। লোরেনা ববিটের কোনও জেল ফাঁসি হয়নি। লোরেনকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে আদালতে বলা হয়েছিলো, ‘লোরেনার মনে হতো, স্ত্রীকে গালি দেওয়ার, মারার, কাটার, যখন ইচ্ছে স্ত্রীর ওপর চড়াও হওয়ার সমস্ত শক্তি ওই ছোট্ট অঙ্গটি থেকে আসে। ওটি কেটে ফেলে দিলেই স্বামী মানুষ হবে।’ এই মনে হওয়া যে অস্বাভাবিক নয়, তা লোরেনের জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করেছিলো। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে লোরেন দিব্যি সুখে আছে এখন। নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মার খাওয়া মেয়েদের উদ্ধার করছে। পুরুষাঙ্গ কর্তন করার উপদেশ জনসমক্ষে না দিলেও মেয়েদের কানে কানে দিচ্ছে কি না কে জানে।
পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে পশ্চিমের নারীবাদীরা সেই সত্তর দশক থেকেই আন্দোলন করছেন। পর্নোগ্রাফি নারীপাচার আর পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি অপরাধের পৃষ্ঠপোষক, এতে কারও দ্বিমত নেই। নারীবাদীরা মনে করেন, পর্নো ছবিতে যে যৌনতা সাধারণত দেখানো হয়, তা হল পুরুষেরা দাপট দেখাবে, মেয়েরা মেনে নেবে। অথবা পুরুষেরা মারবে, মেয়েরা মার খাবে। নারীবাদীদের ভাষায়, ‘পর্নোগ্রাফির মানেই হচ্ছে, মেয়েরা মানুষ নয়, নিতান্তই যৌনবস্তু। এটি সবরকম শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণায় আনন্দ পাবে। ধর্ষণে আনন্দ পাবে। বেঁধে, মেরে, চাবকে, চড়িয়ে, উল্টিয়ে পাল্টিয়ে যা খুশি করা হবে, আনন্দ পাবে। যত তাদের মান, সম্মান, অধিকার আর স্বাধীনতাকে পায়ে মাড়ানো হবে, তত তারা আনন্দ পাবে। যত তারা নির্যাতিত হবে, আনন্দ পাবে।’ পর্নোবিরোধী নারীবাদীরা কিন্তু যৌনতা বা ইরোটিসিজমের বিরুদ্ধে নন। এঁরা ভায়োলেন্সকে ইরোটিসাইজ করার বিরুদ্ধে।
হিউমিলিয়েশনকে, অসম্মানকে, অপমানকে, যন্ত্রণাকে ইরোটিসাইজ করার বিরুদ্ধে। পর্নোগ্রাফির পক্ষে নারীবিরোধী পুরুষ আর পর্নোব্যবসায়ীরা যোগ দিয়েছে সেক্স পজিটিভ নারীবাদীরা, নিন্দুকেরা তাদের নাম দিয়েছে ‘ফিমেল শোভেনিস্ট পিগ।’ এঁরা নারীর যৌন-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যৌন-স্বাধীনতার নামে মেয়েদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট যৌন-পরাধীনতা পতিতাবৃত্তির পক্ষেও এঁরা দাঁড়িয়েছেন। ক্যাথরিন ম্যাককিনন, আন্দ্রিয়া ডোরকিন, রবিন মরগান, ডরচেন লেইডহোল্টদের পর্নোবিরোধী আন্দোলনকে এঁরা যাচ্ছেতাই ভাষায় নিন্দা করেছেন। আশির দশকে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল দু দলে। বিতর্কের নাম লোকে শখ করে দিয়েছে, ‘নারীবাদীদের যৌন যুদ্ধ।’
যুদ্ধে কারা জিতে যাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি। চারদিকে যৌনবিকৃতিরই জয়জয়কার। ইতালির ছেলে রকো সিফ্রেদি খুব নামকরা পর্নো অভিনেতা। এ পর্যন্ত তেরোশরও বেশি পর্নোয় অভিনয় করেছে। নিজেই সে বলে, ওসব তো সেক্স নয়, সে ফ ভায়োলেন্স। সেক্সে নামে মেয়েদের যত ভোগানো হয়, যত যন্ত্রণা দেওয়া হয়, তত জনপ্রিয় হয় পর্নো। তত জনপ্রিয় হয় অভিনেতা। যে মেয়ে মুখ বুজে যত ভায়োলেন্স মেনে নেবে, সে মেয়ের তত আদর। পর্নোছবির দর্শক মূলত পুরুষ। যা দেখতে পুরুষের আনন্দ হয়। তাই দেখানো হয়। পর্নোয় কখনও কোনও মেয়ের স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষার মূল্য দেওয়া হয় না। বিশেষ করে নারীপরুষের যে পর্নো। মেয়েদের যৌন সুখের জন্য বানানো হয় না পর্নো। মেয়েদের দাসীবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, পর্নোবৃত্তি সবই পুরুষের ভোগের জন্য। মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে এসব বৃত্তি তাদের নিরাপত্তার জন্য বা মঙ্গলের জন্য বা অর্থোপার্জনের জন্য। কিন্তু নিজের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে, নিজেকে নির্যাতিত হতে দিয়ে নিজের গ্লানির বিনিময়ে যাই উপার্জিত হোক না কেন, কোনও অর্থেই তার নাম নিরাপত্তা নয়।
কী করে রোধ করা যাবে পর্নোগ্রাফি? সমাজের সঠিক চিত্রটাই তো রাখঢাক না করে দেখানো হয় ওসবে। সমাজে যদি পুরুষেরা ওপরে থাকে আর নারীরা তলায় থাকে, পুরুষেরা মাতব্বরি করে আর নারীরা মাতব্বরি সয়, পুরুষেরা কামড় দেয় আর নারীরা মুখ বুজে থাকে_ তবে পর্নো কেন ভিন্ন হবে। বিকৃতি যদি লোকের মনে এবং মাথায় গোপনে লুকিয়ে থাকে, ভদ্রতার মুখোশ আজ না হোক কাল খসে পড়েই। তবে বিকৃতি চিরস্থায়ী বলে আমি বিশ্বাস করি না। সুস্থ-সুন্দর-সমাজ গড়ার মিছিলে নারী ও পুরুষ উভয়কে যোগ দিয়ে বিকৃতি বিলুপ্তির চেষ্টা বিরতিহীনভাবে করে যেতেই হবে। মন্দ আছে বলে ভালোকে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না! মন্দে ছেয়ে যাবে তবে জগত। আইন প্রণয়ন করে, মানবাধিকার বা সমানাধিকার সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে এ পর্যন্ত অনেক বৈষম্য আর বিকৃতি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। মনে রাখতে হবে, যতদিন না জাতবর্ণধর্মশ্রেণী নির্বিশেষে সকল নারীই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ অধিকার না পাচ্ছে, যতদিন না নারী শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হচ্ছে এবং যতদিন না নারীবিরোধী কুসংস্কারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হচ্ছে, ততদিন নারীর শরীর নিয়ে পুরুষের বিকৃত উৎসব চলতেই থাকবে। বাংলার মুখচোরা হীরেন বা তপনও রকো সিফ্রেদি হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।
লেখক: নির্বাসিত লেখিকা