বিষণ্ণ পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ প্রশ্নমালা
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২০, ১৪:৩৯
হঠাৎ করেই জনজীবন কেমন যেন থমকে গেছে। বাজারে কোলাহল নেই, শিক্ষকের তাড়া নেই, ক্লাস ও পরীক্ষা নেই বলে পড়ার টেবিলে নেই মায়ের বকুনি। প্রতিদিন কেবল সংখ্যার হিসেবকষা আঙুলের কড়ে। এক-দুই করে লাখের ঘরে আক্রান্তর সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিলেও সংখ্যাটা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এরই মাঝে নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মানার সাথে নিজেই নিজেকে বন্দি করেছে মানুষ তার চিরচেনা পরিবেশে। তবে চেনা সেই ধূসর পরিবেশটা যদি একটু সজীবতায় ভরে ওঠে, তবে মনটা নিশ্চয়ই প্রফুল্ল থাকবে।
গৃহবন্দী এ সময়টাকে কাজে লাগাতে বাড়ির পাশের পতিত জমি কিংবা ছাদ বাগান হয়ে উঠতে পারে একান্ত সঙ্গি। বীজ থেকে অঙ্কুরিত চারাগাছ দু'চারটা পাতা মেলে একটু একটু করে বড় হতেই ওরাই হয়ে উঠবে বিপদের বন্ধু। করোনার সময়ে যাতে ঘন ঘন বাজার পরিদর্শনে যেতে না হয় কিংবা ভেজা মুক্ত রাসায়নিক সারের অত্যাধিক ব্যবহার থেকে মুক্তি পেতে এই সবুজ সবজি যেমন খাবারে স্বাদ বৃদ্ধি করবে, তেমনি করোনার বিরুদ্ধে একটু হলেও বেশি শক্তিশালী করে তুলবে। সবথেকে বড় কথা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে করোনা পরবর্তী সময়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবার প্রবল আশংকা রয়েছে। সুতরাং খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সকাল বিকেল সবজি বাগানে কাজ করতে নিশ্চয়ই কারো খারাপ লাগার কথা নয়।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু যে গাছদের অনুভূতির কথা বলেছেন, গাছের সাথে থাকলেই কেবল বোঝা যায় সে অনুভূতি। শিশুর মতো বাড়তে থাকে এরা, ভালোবাসলে উজাড় করে দিতে পারে তার সবটা ফল-ফলাদি, শাকসবজি দিয়ে। আমার বারান্দায় একটা শখের বাগান করেছি। এই বাগানে পাখি বসবে, ঝর্ণার আওয়াজ পাওয়া যাবে, এমন একটা চাওয়া ছিল অনেক দিনের। এবার সেই শখ পূরণ হলো। এখন এই বারান্দায় বসলে আমার মন ভাল হয়ে যায়।
অন্য পাখি যেমন তেমন, কাক আসে প্রতিদিন। আমি খাবার দেই ওদের। গতকাল সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, এ কারণে কাকদের খাবার দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে কাকদের খাওয়া দিতে যাই ছাদে। খুব খুশি হয়। সম্ভবত কাকের ভাষায় 'থ্যাংক ইউ' বলে। কাল বিকেলে যখন খাবার দিতে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে কা কা করে বকলো আমাকে, আর খেলই না। অভিমান, সকালে কেন দেইনি!
আয়নার সামনে গিয়ে নিজের দিকে তাকাই। প্রায়ই মনে হয় ভেতরে অন্য একজন দাঁড়িয়ে আছে। যখন সাজতে শুরু করি, শেষ করার পর মনে হয়- তৃতীয় আরেকজন! এদের সাথে আমার সাজের সম্পর্ক ছাড়া আর সম্পর্ক নাই! করোনার সময়ে এই সম্পর্কও কতদিন টিকে থাকবে, কে জানে?
'নিজেকে জানো' বলতে যত সোজা, বাস্তবে তার প্রয়োগ অনেক কঠিন। আমি হয়তো যা জানতে পারি তা হলো আমার সম্পর্কে আমি কী চিন্তা করি, কিন্তু আমি আসলে কী তা জানা যায় না। আর আমি তো কোন অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা না, প্রতিনিয়ত আমার মধ্যে চলে ভাঙাগড়ার খেলা, আমার জেনেটিক গড়ন, জৈবিক প্রবাহ, মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ তো সব সময় আমাকে জানিয়ে ঘটছে না, অনেক কিছুই ঘটে আমার অজান্তে, মাইক্রো লেভেলে। আর আমার ইচ্ছা, প্রায়োরিটি, কার্যকলাপ আজকে যা, অতীতে তা ছিল না, দুই সপ্তাহ পরেই তা একই থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আর অনেক কিছু থাকে সাব-কনসাস লেভেলে, যা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরিবেশে হঠাৎ করেই আত্মপ্রকাশ করতে পারে পূর্বের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়ে। যেমন সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে করোনা পরিস্থিতি।
আমার সাথে বাহিরের পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ঘটে, যোজন-বিয়োজন ঘটে, সচেতনে ঘটে, অসচেতনে ঘটে, ইচ্ছায় ঘটে, অনিচ্ছায় ঘটে, বাধ্য হয়ে ঘটে, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘটে। তাই এই চলমানতার স্রোতে আমি কী তা স্থির থাকে না, ফ্রাকশন অব সেকেন্ডেই অনেক পরিবর্তন ঘটতে পারে আমার মধ্যে, ঘটেও। পূর্বের অবস্থানের সাথে যার পার্থক্য অনেক হতে পারে। 'নিজেকে জানো' তাই একটা কঠিন বিষয় যার কোন সমাধান নেই।
তবে আমি কী, আমি কে, এই জীবনের অর্থ কী, অর্থপূর্ণ জীবনযাপন, সুখী জীবনযাপন, নৈতিকতাপূর্ণ জীবনযাপন, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন কেমন? এসব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে মানব জীবন পার করা কঠিন। করোনা পরিস্থিতিতে এসে এসব প্রশ্নের মুখে আরও বেশি করে পড়ছি।
পৃথিবী আজ অসহায়, বিষণ্ণ, বিপর্যস্ত, নিঃসঙ্গ, বিশাল মৃত্যুর ছায়ায়। অথচ এমন শূন্যতর দিনে কি সুন্দর বাতাস বইছে। বিপন্ন মানুষ কাঁদছে খুব একা, বড় একাকী অস্তিত্বের গৃহডোরে! শোকের ছায়া আর দীর্ঘ না হোক।
লেখক: স্নাতক শিক্ষার্থী
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৯ জুন ২০২০